শষ্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁ। আর জেলার বদলগাছী উপজেলা সবজি ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে এ উপজেলায় সবজির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে মসলা ও নানা ফলের বাগান। চাষাবাদে বেড়েছে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার। এতে করে বাড়ছে উৎপাদন। তরুণ উদ্যোক্তার পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে স্মার্ট কৃষক।
এসবের কারিগর হচ্ছেন বদলগাছী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হাসান আলী। যার হাত ধরে উপজেলার কৃষিতে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। তিনি উপজেলাবাসীকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে কৃষিকে এগিয়ে নিতে অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় কৃষি জমির পরিমাণ ১৬ হাজার ৪৫৪ হেক্টর। বসতবাড়িসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি হওয়ায় গত সাত বছরে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩৫ হেক্টর। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় ২৫ হেক্টরে মাল্টা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই দশমিক ২৫ হেক্টর জমিতে কমলার আবাদ হয়েছে। যা আগে কখনো আবাদ হয়নি। উপজেলায় ড্রাগনের আবাদও শুরু হয়েছে। এছাড়া বরই ও অসময়ে তরমুজ চাষসহ বিভিন্ন ফলবাগান গড়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরে উপজেলায় ফসল চাষের নিবিড়তা শতকরা চার ভাগ বেড়েছে।
উন্নয়ন সহায়তার আওতায় ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে সরাসরি কৃষক পর্যায়ে যন্ত্রপাতি বিতরণের মাধ্যমে কৃষিতে যান্ত্রিকীরণ করা হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত পরামর্শ, প্রদর্শনী, মাঠ দিবস, প্রশিক্ষণসহ নানা মাধ্যমে কৃষকদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ১ মার্চে কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে এ উপজেলায় যোগদান করেন তিনি। গত প্রায় সাত বছর এ উপজেলায় কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন হাসান আলী।
উপজেলার প্রধানকুন্ডি গ্রামে রাইয়্যান এগ্রো ফার্ম গড়ে উঠেছে। যেখানে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রায় এক বিঘা জমিতে পলিনেট হাউস তৈরি হয়েছে।
উদ্যোক্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, ২০১৯ সালে আমার খামারের যাত্রা শুরু হয়। এখন প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে মাল্টা, কমলা, আম, বরই ও পেয়ারাসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফলের বাগান রয়েছে। কৃষিকে আধুনিকায়নের লক্ষে কৃষি অফিস থেকে পলিনেট হাউস তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে কিছুদিনের মধ্যে চাষাবাদ শুরু হবে। পলিনেট হাউসে অসময়ে ক্যাপসিকাম, সাম্মাম ফলসহ বিভিন্ন বিদেশি ফল চাষ হবে।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। বলা যায়- কৃষিতে উৎসাহিত করতে কৃষি অফিস থেকে ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি।
ভাতশাইল গ্রামে যুব এগ্রো ফার্মে রয়েছে মাল্টা, কমলা, আম বাগান ও নার্সারি। প্রাকৃতিক কৃষি নিয়ে কাজ করছেন আধাইপুর ইউনিয়নে তরুণ কৃষক রকিবুল হক। তিনি গাছ আলু, বরই, মাল্টা ও আম বাগান করেছেন। সেখানে কীটনাশকমুক্ত শাক-সবজি চাষে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
উদ্যোক্তা পলাশ হোসেন বলেন, তিন বছর আগে নিজের ছয় বিঘা জমিতে মিশ্র চাষাবাদ করি। পরে আরও দুই বিঘা জমি ইজারা নিয়েছি। অরগানিকভাবে চাষাবাদের চেষ্টা করছি। বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি এবং লাভবানও হচ্ছি। অনেকেই এখন কৃষিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বলরামপুর গ্রামে আন নাফি এগ্রো ফার্মে কেঁচো সার উৎপাদন করছেন উদ্যোক্তা সবুর হোসেন। এছাড়া কোলাতে গৃহবধূ মিনি আরা বেগম ভার্মি কমপোস্ট সার, আধাইপুরে গৃহবধূ গৌরি রানী ও দারিশন গ্রামে আব্দুল হান্নান কেঁচো সার উৎপাদন করছেন।
উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের তরুণ স্মার্ট কৃষক আব্দুর রউফ। মশলা জাতীয় ফসল উৎপাদের পাশাপাশি গত পাঁচ বছর থেকে মাল্টার বাগান করেছেন। এছাড়া বীজ উৎপাদন করে বাজারজাত করছেন তিনি।
আব্দুর রউফ বলেন, স্মার্টফোনের ব্যবহার কৃষিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ফসলের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে অ্যাপের মাধ্যমে জানতে পারছি। চাষাবাদের জন্য ভর্তুকিতে একটি পাওয়ার টিলার পেয়েছি। কোন মৌসুমে কোন ফসল চাষাবাদ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে সেসব বিষয়ে পরামর্শ পেয়েছি।
বদলগাছী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হাসান আলী বলেন, কৃষিকে আধুনিক ও যান্ত্রিকীকরণ এবং স্মার্ট উদ্যোক্তা কৃষক তৈরির কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ড্রাগন, মাল্টা, কমলা, পেয়ারাসহ দেশি-বিদেশি ফল ও ফসল উৎপাদন করে উপজেলার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। অসময়ে মাচায় তরমুজ চাষ হচ্ছে। আমি যোগদানের আগে এসব হতো না।
তিনি আরও বলেন, উপজেলায় প্রায় ১০ জন কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে যারা বিভিন্ন সময় ফল ও ফসল উৎপাদনসহ এবং বাজারজাত করে সফল হচ্ছেন। এসব উদ্যোক্তাদের কীটনাশকমুক্ত নিরাপদ ফল ও ফসল উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে আগাম কৃষি আবহাওয়ার বিষয়ে জানতে পারছেন কৃষকরা।
কৃষিবিদ হাসান আলী বলেন, আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে কিন্তু ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া বাসতবাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান করে সবজির চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। এছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পেও পারিবারিক পুষ্টি বাগান তৈরিসহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।