করোনা মহামারির অভিঘাতে গত দেড় বছর ধরে সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিনোদনমাধ্যম যাত্রাপালা। বেকার হয়ে পড়েছেন দলের মালিক, শিল্পী-কলাকুশলীরা। অর্থাভাবে প্রায় সবাই ছেড়েছেন পেশা। জীবিকার দায়ে অনেক দক্ষ অভিনয়শিল্পী, গায়ক, বাদক ও পালাকার চলে গেছেন দল ছেড়ে। কেউ চালাচ্ছেন অটোরিকশা-ভ্যান, কেউ খুলেছেন মুদি দোকান। কেউ পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। কেউ-বা কায়িক শ্রম দিয়ে জীবনধারণ করছেন। ভালো নেই যাত্রাপালার মঞ্চ কাঁপানো রাজা-রানি-সেনাপতিরাও।
রাতের আঁধার চিরে লাইটের কম্পন আর ড্রামের তালে মঞ্চে প্রবেশ করা কড়া মেকআপের রঙিন মানুষগুলোর অবস্থা বাস্তবে নিদারুণ কষ্টের। এমনিতেই পরিবেশনা শিল্প যাত্রাকে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছিল। অতীতে এই শিল্পের যে বিত্তবৈভব ছিল, তা ম্রিয়মাণ। অশ্লীলতা, জুয়া-হাউজি, ইন্টারনেটভিত্তিক বিনোদনের সহজলভ্যতায় ক্রমেই রুগ্ন, ক্ষয়িষ্ণু ও নিষ্প্রভ করে দিয়েছে যাত্রার জৌলুশ।
মঞ্চ থেকে হারিয়ে গেছে, রহিম বাদশা-রূপবানকন্যা, কমলা রানির বনবাস, গুনাইবিবি, আপন-দুলাল, সাগর-বাদশা, লাইলী-মজনু, কাজল-রেখা, প্রেমের সমাধি তীরে, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, মা হলো বন্দি, জেল থেকে বলছি, জীবন নদীর তীরেসহ অসংখ্য তুমুল জনপ্রিয় পালা। কিন্তু ডিজিটাল যুগের প্রভাবে ক্রমশ বিলুপ্ত হতে চললেও শিল্পকলা একাডেমিতে নিবন্ধিত ১১৭টি যাত্রাদল গ্রাম-গঞ্জের নববর্ষ, পূজা-পার্বণ-মেলাকে কেন্দ্র করে মাঝেমধ্যে যাত্রাপালা মঞ্চায়ন করত। এখন এই শিল্প করোনা মহাসংকট পেরিয়ে আবারও মঞ্চে ফিরে আসবে সেই ভরসা নেই সংশ্লিষ্টদের।
মিলন কান্তি দে বলেন, আগস্ট থেকে রিহার্সেলের মৌসুম শুরু হচ্ছে। কিন্তু অনিশ্চয়তার কারণে কেউ রিহার্সেল করবেন না। একটি যাত্রাদলে যন্ত্রশিল্পী, মেকআপম্যান, অভিনয় শিল্পী মিলে প্রায় ৪০ জন, কোনো কোনো দলে তারও বেশি মানুষ কাজ করেন। তাদের প্রায় সবাই এই যাত্রার ওপরই নির্ভরশীল। করোনায় গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তারা সবাই বেকার। করোনা ভালো হওয়ার লক্ষণ না দেখে কিছু যাত্রাশিল্পী পেশা বদল করেছেন। অর্থাভাবে খেয়ে না খেয়ে, ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দিন কাটছে তাদের। অনেকে চিকিত্সা করাতে পারছেন না। যাত্রাদলের অনেক সদস্য কাজের খোঁজে বহু আগেই গ্রাম ছেড়েছেন।
নরসিংদীর যাত্রামঞ্চ কাঁপানো ভিলেন অভিনেতা ফরিদ আহম্মেদ বলেন, দেশ থেকে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালা বিলুপ্তির পথে। তাই সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছি। কোনো উপায় না দেখে মাছ বিক্রি করছি। নব্বই দশকের দিকে নরসিংদীসহ সারা দেশে মঞ্চ কাঁপানো গীতিনাট্যের অভিনেতা আলী আহম্মেদ জীবিকার তাগিদে এখন ভেলানগর বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাতে বসে পান-সিগারেট বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, আমাদের খবর এখন আর কেউ নেয় না।
যাত্রাশিল্পীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল যাত্রাশিল্পীদের জন্য সুদিন। তারপর থেকে আস্তে আস্তে এ শিল্পে অশ্লীলতা, জুয়া-হাউজি ঢুকে পড়ে। ডিশ এবং ইন্টারনেটভিত্তিক বিনোদন সহজলভ্য হয়। অনেক যাত্রাপালার মালিক অধিক মুনাফার আশায় অশ্লীলতার দিকে ঝুঁকে পড়লে প্রশাসন থেকে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। এ শিল্পের দুর্দিন চললেও নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেক দলের কাছ থেকে শিল্পকলা একাডেমি ৫ হাজার টাকা করে নেয়। এ পর্যন্ত ১১৭টি যাত্রা দল নিবন্ধন করেছে। আরো কয়েকটি নিবন্ধনের আবেদন করেছে। কিন্তু তারা যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে বিশেষ কিছুই করছেন না বলে যাত্রাশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন।
যাত্রাপালা একটি মৌসুমি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সারা বছর ধরে এটি অনুষ্ঠিত হয় না। পেশাদার যাত্রাপালা আয়োজনের সময়সীমা ছয় থেকে সাত মাস। জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণের মাঝামাঝি অর্থাত্ মে, জুন, জুলাই—এ তিন মাস আসন্ন মৌসুমের জন্য প্রত্যেক দলের সাংগঠনিক প্রস্তুতিকাল। এ সময়ে লাইসেন্স গ্রহণ, নবায়ন, পুঁজি সংগ্রহ, শিল্পী-কলাকুশলী সংগ্রহ ও চুক্তিকরণ, পালা নির্বাচন, বাক্সপেটরা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অন্য সামগ্রী সংগ্রহ এবং মেরামত করা হয়। শ্রাবণের শেষ ভাগ থেকে ভাদ্রের শেষ ভাগ (আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) যাত্রাপালার মহড়াকাল। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রার মৌসুম শুরু হয় দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন থেকে। অর্থাত্ সেপ্টেম্বরের শেষ কিংবা অক্টোবরের প্রথম দিকে। যাত্রানুষ্ঠান আয়োজনের সমাপ্তি টানা হয় চৈত্রের শেষের দিকে অর্থাত্ এপ্রিলের মাঝামাঝি। কিন্তু করোনা, লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে পেশাদার যাত্রাশিল্প এবং এর সঙ্গে জড়িতরা হারিয়ে যাচ্ছেন। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার এককালের বড় চিত্তবিনোদন শিল্প।