ব্যস্ত ঢাকা শহর ধীরে ধীরে হচ্ছে নিস্তব্ধ।অফিস – আদালত, বাসা-বাড়ি সবই এখন শূণ্য। দুদিন আগেও বাস স্টান্ড, লঞ্চ ঘাট,ইয়ারপোর্ট সব জায়গায় ছিল ভিড়ের তুমুল ঝড়!ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য সকলের মঝেই চলছিল বিশ্ব ম্যারাথন প্রতিযোগিতা! রক্তাক্ত রবির উত্তপ্ত রাগে শরীরে ঘর্মঝর্ণার মেলা বসলেও প্রতিযোগিতার হাল ছাড়তে রাজি নন কেউ! শত আশা-আকাঙ্খার পরেও পরিস্থিতির শিকার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে দেয়নি (ছদ্মনাম)তাহের সাহেব ও তার পরিবারকে! সল্প বেতনের ছোট্ট একটি কোম্পানিতে চাকুরী করেন তিনি। ঢাকায়, একটি ছয়তলা বড়িতে সাবলেট থাকেন।
তিনি ব্যতিত বাকি সবাই এবার ঈদছুটিতে বেড়াতে গিয়েছেন নিজেদের বাড়িতে। আজ ঈদুল আজহা,প্রাকৃতিরা যেন সূর্যি মামার কাছে জেদ ধরেছে, যে আজ চলবে না তোমার কোন তেজ! তাহের সাহেব ঈদের নামায শেষ করে বাসায় এসেছেন।তারপর ছাদে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতাসের সাথে নিজেকে যুক্ত করে খুব করে উপভোগ করছেন প্রাকৃতির রূপালী দৃশ্যটাকে।হঠাৎ হৈচৈর আওয়াজ এসে হাজির হলো কর্ণফাকের দরজায়,মনে কৌতূহল নিয়ে নিচে তাকালেন। চোখের পলক পরতেই ভেসে উঠেছে রক্তবন্যায় খুশির ঢেউ! সকলেই নিজেদের কোরবানীর পশু নিয়ে ব্যস্ত,কেউ দিচ্ছে গরু কেউ বা ছাগল, একজন তো উট কোরবানী করছে।কী মায়াবতী এক দৃশ্য! মুনিবের সন্তুষ্টির জন্যে এতো আত্মত্যাগ।
এসব দেখে তাহের সাহেব মনে মনে ভাবছেন, আহ! আমিও যদি তাদের মত কোরবানি দিয়ে নিজেরর প্রতিপালক কে খুশি করাতে পারতাম? ছাদ থেকে বাসায় এসে স্ত্রীকে বললেন, শুনছো এক কাপ চা দিও। স্ত্রী রান্নাঘরে চা বানাতে গেলে তাহের সাহেব তার একমাত্র সন্তান মাহবুব আলীকে নিয়ে খেলা করছেন। কিছুক্ষণ পর স্ত্রী এসে বলল এই নাও তোমার চা। চায়ের কাপটা হাতে নিলেন, যেই চায়ে চুমুক দিবেন অমনি নাকের ছিদ্র ভেদ করে ঢুকে পরল ঝালে ভরা সুস্বাদু একটি ঘ্রাণ! মুখে একটু হাসির ছাপ নিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা এই ঘ্রাণটি কিসের ? মনে হয় পাশের বাসার ভাবি গোশত রান্না করছে। হাসির ছাপটা মুহূর্তেই অদৃশ্য। তাহের সাহেব চুপ মেরে রইলেন। ভাবছেন কোরবানি দিতে পারিনি বলে তার বরকতময় মাংস আহার থেকেও কি বঞ্চিত থাকবো? কিন্তু মাংস পাবো কোথায়? ছয়তলা বাড়িতে থাকি! কেউ দেখলে বলবে লোকটি প্রফুল্ল চিত্তে জিবন কটাচ্ছে! তহলে কি এবার কোরবানির গোশত খাওয়া হবে না? না না তা কেন হতে যাবে? আল্লাহ চাইলে অবশ্যই পাবো। বিকেল নেমে এসেছে, তহের সাহেব তার স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে বাহিরে বের হলেন।
আসলে ঢাকা শহরে অনেক গরিব লোকেরা তাদের পওয়া কোরবানির গোশত বিক্রি করে থাকেন। তাই বুক ভরা আশা নিয়ে তাহের সাহেব তাদের সন্ধানেই মাঠে নেমেছেন। ঐ এলাকার অলি-গলি, মাঠ-মার্কেট সর্বত্রেই খুজলেন। খুজতে খুজতে বিকেল পেরিয়ে গোধলী, সন্ধাকে সরিয়ে রাত্র। কিন্তু তাহের সাহেবের হাতে এখন অবধি দু টুকরো গোশতের ছোঁয়া লাগেনি। হতে হতে এখন রাত ৮.৩০ টা। বিকেল থেকে হাঁটাছেন তাঁরা। পুরো শরীরে এখন ক্লান্তির অভিযান! তাই সব আশা ঝেড়ে ফেলে ছোট্ট ছেলটিকে বললেন বাবা এবার বোধহয় কোরবানির মাংস খাওয়া হবে না! ছেলেটি ফ্যাল ফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তাহের সহেব ছেলেটিকে কোলে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলেন।
চারপাশে ফাকা-নিস্তব্ধ কোথাও মানুষেন আনা-গোনা নেই। রাস্তার পিঠে আপসোস এর ছায়া নিয়ে হাঁটছে, তাহের সাহেব ও তার পরিবার। আচমকা চোখে কি একটা ঝাপসা বারি খায়, তাকিয়ে দেখে দক্ষিণ দিক থেকে এক বৃদ্ধ লোক দ্রুত গতিতে কোথায় যেন যাচ্ছে। লোকটিকে নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই তবে লোকটির হাতে একটি গোশতের প্যাকেট! লোকটি কাছাকাছি এলে তাহের সাহেব আসার আলো নিয়ে জিজ্ঞেসা করলেন, আচ্ছা চাচা গোশতগুলো কি বিক্রি করবেন? হ বেছুম, তুমি নিবা নি? গোশতডি একজনে আমার মায়রে দিছে, আমার মার তো অসুক এল্লিগা।
তাহের সাহেব অবাক সুরে বললেন, আপনার মায়ের জিনিস বিক্রি করবেন! কিন্তু কেন? আমার মার লাইগা আরো গোশত নিছি তুমি ছাইলে এইডা নিবার পারো। তো চাচা দাম কত? এইহানে এক কেজির বেশি আছে, তুমি আমারে দেরশ টেহা দিও তাইলে হইবো। তাহের সাহেবের মনে যেন খুশির চাঁদ উঠেছে! চাঁদের জোসনায় কৃণকায় দেহটাও তাজা হয়ে গেল! তাহের সাহেব হাসি মুখে লোকটির কাছ থেকে দেড়শত টাকা দিয়ে গোশতগুলো কিনে নিলেন। বাসায় এসে ঝটপট গোশত রান্না করলেন তাহের সাহেবের স্ত্রী। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে প্রাণখুলে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, আলহামদু লিল্লাহ্ শুকরিয়া জানাই ঐ সত্তার যিনি রিজিকের মালিক `রাজ্জাক’।
মুহাম্মাদ নাজমুস শাহরিয়ার গালিব সামি।