গোপালগঞ্জের নোকুলের চর গ্রামের সত্তরোর্দ্ধ তাহাজ্জল মোল্লা মঙ্গলবার রাতে বাড়িতে হার্ট অ্যাটাক করেন। এর আগে তিনি জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন। প্রতিবেশীদের পরামর্শে রাতেই একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে পরিবারের সদস্যরা। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হয় ৭ হাজার টাকা। একদিন পর বৃহস্পতিবার ভোরে সেখানেই তাহাজ্জল মারা যান। সকালে হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য তাহাজ্জল মেয়ের জামাই ইমদাদুল অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করতে যান। ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত তার কাছে চাওয়া হয় ১১ হাজার টাকা।
বিপদে পড়ে ইমদাদুলের মতো এরকম অ্যাম্বুলেন্স ‘ভাড়া নৈরাজ্যের’ শিকার হতে হয় অগণিত রোগীর স্বজনকে। সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স।
একজন চালক জানালেন, এসি বন্ধ করে নন এসিতে অ্যাম্বুলেন্স গেলে ২ হাজার টাকা ভাড়া কম হবে। ইমদাদুল হক বলেন, এই গরমের মধ্যে নন এসিতে কিভাবে লাশ নিয়ে যাব? জীবিত শ্বশুরকে ঢাকায় আনতে ভাড়া দিতে হয় ৭ হাজার টাকা। আর লাশ নিয়ে যেতে ৪ হাজার টাকা বেশি গুনতে হলো।
চাঁদপুরের হাইমচরের আলগীবাজারের মোহাম্মদ কালু (৬৫) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বুধবার সন্ধ্যায় মারা যান। রাতেই লাশ গ্রামের বাড়িতে নেওয়ার জন্য মৃতের নাতি সীমান্ত হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করতে যান। কিন্তু হাইমচর পর্যন্ত ৭ হাজার টাকা ভাড়া দাবি করলেন চালক।
সীমান্ত বলেন, অন্যান্য অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে যাচাই বাছাই করবেন, তারও কোন উপায় নেই। কারণ, একজন যে ভাড়া বলবেন সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা তার কমে যাবেই না। সবাই ওই একই ভাড়া কিংবা তার বেশি দাবি করবে। তখন বুঝতে পারি যে এটা একটা দুষ্টচক্র। তাই আগের চালকের সঙ্গেই ২শ টাকা কমে রফা করে লাশ নিয়ে রওনা দিই বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালে বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদক নিজেই করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির আত্মীয় সেজে হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে দরদাম শুরু করেন। উত্তম সাহা নামে অ্যাম্বুলেন্সের চালককে বলা হল, রাজশাহীতে লাশ নিয়ে যেতে কত লাগবে। তিনি ১২ হাজার টাকা দাবি করে বসলেন। এই প্রতিবেদক বলেন, ২ হাজার টাকা কম নেন।
তখন চালকের দাবি, ‘একটা অ্যাম্বুলেন্স রাজশাহী পর্যন্ত যাওয়া ও ঢাকায় আসা পর্যন্ত ৪ হাজার টাকা জ্বালানি খরচ হয়। চালক ও হেলপারের ২ দিনের খাওয়া খরচ ২ হাজার টাকা। এরপর আর কত টাকাই বা থাকে।’ উত্তম বলেন, ‘ঢাকার বাইরে অ্যাম্বুলেন্সের ট্রিপ নিয়ে গেলে লাভ তেমন হয় না। ঢাকার ভিতরে বা ঢাকার আশেপাশের এলাকায় ট্রিপ নিলে অনেক লাভ।’
জানা গেছে, চিকিত্সা সেবা নিতে এসে দালালদের খপ্পরে পড়ে রোগীর পরিবার সর্বশান্ত হয় । এরপর রোগীর মৃত্যু হলে লাশ বাড়ি পর্যন্ত নিতে গিয়ে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয় মাস ধরে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্য নিজের নাম পত্রিকায় লিখতে নিষেধ করেন।
তিনি বলেন, হাসপাতালে প্রতিটি ওয়ার্ডে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীদের লোকজন দর্শনার্থী সেজে ঘোরাফেরা করে। তারা যখন বুঝতে পারে যে ওই রোগী মারা যেতে পারে, তখন ওই রোগীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুব ভাল আচরণ শুরু করে। পরবর্তীতে রোগী মারা গেলে লাশ পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের সন্ধান দেন। একে তো স্বজনের মৃত্যু, তার ওপর লাশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ বাড়ি নেওয়া যায় ততই মঙ্গল- এ ধরনের চিন্তা থেকে চালকদের দাবিকৃত গলাকাটা ভাড়ায় লাশ নিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করে স্বজনরা। হাসপাতালের সামনে অবস্থান করা অ্যাম্বুলেন্সগুলোর সঙ্গে দরদাম করে কোনো লাভ হয় না। তারা প্রথমবার যে ভাড়া বলবে সেটাই ‘শেষ ভাড়া’। কারণ, আগের সিন্ডিকেট সদস্য অন্য চালকদের কাছে মৃত ব্যক্তির নাম ঠিকানা এবং কোথায় যাবে সব বলে দেয়। ফলে নতুন করে কোন অ্যাম্বুলেন্স কম ভাড়ায় যেতে রাজি হবে না।
এরকম অ্যাম্বুলেন্স ও লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি নিয়ে রাজধানীর সরকারি- বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চলছে সিন্ডিকেট বানিজ্য। আগারগাঁওয়ের ষাট ফিট রোডে রীতিমত অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। আবার হাসপাতালগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং নিয়ে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। মোট ভাড়ার ওপর ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন যায় ওই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের পকেটে। রাজধানীর প্রায় ৪ হাজার অ্যাম্বুলেন্সকে ঘিরে এমন সিন্ডিকেট বানিজ্য প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, অ্যাম্বুলেন্স সেক্টরে কোনো নীতিমালা না থাকায় মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ছে। একটি নীতিমালার জন্য হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে।’
তবে রোগী বা লাশ জিম্মি করে অধিক ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে বলেন, পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় আমরা কমিশন দিতে বাধ্য হই। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে এ্যাম্বুলেন্স যাতায়াতের সময় লাগে অনেক। তাছাড়া সেতু ও ফেরির টোল দিতে হয়। অথচ অ্যাম্বুলেন্সের কাছ থেকে টোল নেওয়ার কোন বিধান নেই। কিন্তু ইজারাদাররা এই নির্দেশনা মানছে না। এরও আর্থিক প্রভাব পড়ে রোগী বা তাদের স্বজনের ওপর।