আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারের পাঁচ কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে এ সংক্রান্ত পাঁচটি পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিভাগীয় মামলাও হয়েছে। উল্লেখ্য, ২৩ জুন যুগান্তরে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় ২০০ ঘর নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি দলও আলাদাভাবে তদন্ত করে।
তদন্তে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। কাজেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। বলা প্রয়োজন- দুর্যোগসহনীয় গৃহনির্মাণ প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প- এই তিন প্রকল্পের আওতায় সরকার সারা দেশে হতদরিদ্রদের গৃহনির্মাণ করে দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা গিয়েছিল, যারা প্রকৃতই এমন গৃহ পাওয়ার যোগ্য, তারাই এ সুবিধা ভোগ করবেন। কিন্তু বাস্তবে সারা দেশে এসব ঘর নির্মাণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বণ্টন নিয়ে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে।
আলোচিত মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে দেখা গেছে, প্রকল্প কার্যালয় থেকে প্রেরিত প্রাক্কলনে ঘরের চালে লাগানো টিনের পুরুত্ব ৩৬ মিলিমিটার হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া গেছে ৩২ মিলিমিটার। এছাড়া প্রাক্কলনের নকশা অনুযায়ী কাজ না করে ফাউন্ডেশনসহ ইট, রড ও সিমেন্ট ব্যবহারেও বিভিন্ন অনিয়মের আশ্রয় নেওয়ায় বেশ কিছু ঘরের ফাউন্ডেশনসহ অর্ধনির্মিত দেওয়াল ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে।
লজ্জার বিষয় হলো, যেখানে এসব ঘর কেবল সমাজের হতদরিদ্রদেরই পাওয়ার কথা, সেখানে দেশের কোনো কোনো স্থানে তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বরাদ্দ নিয়েছেন। এর ফলে গৃহহীন দরিদ্র মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, অনেক ক্ষেত্রে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার দেশের ভূমিহীন দরিদ্র মানুষের বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করে তাদের জীবনধারা স্বাভাবিক ও সমুন্নত রাখার চেষ্টা করে থাকে। উদ্দেশ্যটি যে মহৎ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাম ভাঙিয়ে সরকারের টাকায় দুর্বৃত্তদের ভাগ বসানো এবং প্রকল্পের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এর ফলে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তার অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বর্তমানে করোনা মহামারিতে দরিদ্র মানুষ নানামুখী জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রকৃত অসচ্ছল ও দরিদ্র ব্যক্তিদের মানসম্মত ঘরপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ, সুনীতি ও সুশাসন নিশ্চিত করার দিকেও সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দিতে হবে। বস্তুত হতদরিদ্রদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্পে সব ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। ‘গরিবের হক’ বলে একটি কথা চালু আছে। সেই হক নিয়ে ‘নয়ছয়’ হবে কিংবা সেখানে বিত্তবানরা ভাগ বসাবে- এটা হতে পারে না।