এবারের এসএসসি ও এইচএসসির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিয়েই গ্রেড নিতে হবে। করোনা সংক্রমণের বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিকল্প পদ্ধতিতে তাদের মূল্যায়ন করা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে এই প্রক্রিয়া। গত বছরের মতো ‘অটোপাশ’ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘বিকল্প পদ্ধতি’ খুঁজে বের করতে ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞদের কাজ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকরা একাধিক বৈঠক করেছেন। এই কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে সৃষ্ট উদ্বেগ দূর করার পাশাপাশি বিকল্প পন্থা ও এ সংক্রান্ত রোডম্যাপ জনসমক্ষে প্রকাশের লক্ষ্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি যে কোনোদিন সংবাদ সম্মেলনে আসছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বুধবার বলেন, ‘আমাদের এখন পর্যন্ত চিন্তা হচ্ছে, ঘোষিত সিলেবাসের আলোকে নির্ধারিত ক্লাস করানোর পর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হবে। তবে পাশাপাশি বিকল্প চিন্তাও চলছে। মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মূল্যায়ন করেই শিক্ষার্থীদের গ্রেড দেওয়া হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে কীভাবে সেই মূল্যায়ন করা যায় এবং এ ক্ষেত্রে যত রকম বিকল্প আছে সবগুলো নিয়েই বিশ্লেষণ চলছে। আমাদের জন্য উপযোগীটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত আকারে গ্রহণ এবং পরিকল্পনা ও রোডম্যাপ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া হবে।’
নাম প্রকাশ না করে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওই কমিটির একাধিক প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, রচনামূলক বা সৃজনশীল প্রশ্ন (সিকিউ) বাদ দিয়ে কেবল বহু নির্বাচনী প্রশ্নে (এমসিকিউ) পরীক্ষা নেওয়া। বিষয় ও পূর্ণমান (পরীক্ষার মোট নম্বর) কমিয়ে পরীক্ষা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ের দুই পত্র একটিতে একীভূত করা।
পাশাপাশি ২০০ নম্বরের স্থলে ১০০ নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এই উভয় ক্ষেত্রেই করোনা পরিস্থিতির উন্নতি জরুরি। অর্থাৎ সংক্রমণ ১০ শতাংশের নিচে নেমে এলে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে পরীক্ষা নেওয়া হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে কেন্দ্র সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ করে এই পরীক্ষা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে আরও একটি দিক ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি হচ্ছে, আগের ফল এবং অ্যাসাইনমেন্টের মূল্যায়নের ওপর এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের গ্রেড দেওয়া।
এর মধ্যে এসএসসির সম্পর্কে বলা হচ্ছে, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার ফলের ৫০ শতাংশ এবং অ্যাসাইনমেন্টের ৫০ শতাংশ ফলাফল নিয়ে ফল প্রস্তুত করা হতে পারে। আর এইচএসসির ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীর এসএসসির ফলের ৫০ শতাংশ, জেএসসির ২৫ শতাংশ এবং অ্যাসাইনমেন্টের ফলের ২৫ শতাংশ সমন্বয় করে ফল প্রস্তুত করা হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, যদি পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষা নেওয়া না যায় তাহলে বিকল্প পদ্ধতিতে মূল্যায়নের পরই শিক্ষার্থীদের ফলাফল তৈরি করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অটোপাশ বা আগের ফলের ভিত্তিতে গ্রেড দেওয়ার কোনো চিন্তা আমাদের নেই। ডিসেম্বরের মধ্যে এই অধ্যায় (এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা) শেষ করতে চাই।
সার্বিকভাবে এ নিয়ে বিকল্প বের করতে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। অটোপাশ না দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত বছর এইচএসসির ক্ষেত্রে আগের ফল মূল্যায়ন করে গ্রেড দেওয়া হয়েছে। তারা মনোকষ্টে আছেন। তাই এবার তেমন হবে না। তাছাড়া এবারের পরীক্ষার্থীদের আমরা কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দেইনি।
তাই আগের ফলের সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্টের মূল্যায়ন নম্বর বিবেচনার সুযোগ কোথায়। ছোট আকারে হলেও পরীক্ষা বা মূল্যায়ন হবে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে আশপাশের দেশে বা ইউরোপ-আমেরিকায় কী পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে সেগুলোও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
সাধারণত প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি এবং এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষা হয়ে থাকে। কিন্তু গতবছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রায় ৩ কোটি ছাত্রছাত্রীর মতোই এ দুই পরীক্ষার শিক্ষার্থীরা গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে সরাসরি ক্লাসরুমে বসতে পারেনি। এদের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা নবম শ্রেণিতে স্বাভাবিক লেখাপড়া করলেও দশম শ্রেণিতে আড়াই মাস স্কুলে যেতে পেরেছে।
এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির পর ৭-৮ মাস ক্লাস করতে পেরেছে। দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠেছে অটোপাশ নিয়ে। এই শ্রেণিতে একটি দিনও ক্লাস করতে পারেনি। এবার এসএসসি ও এইচএসসিতে পরীক্ষার্থী প্রায় ৩৭ লাখ। মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা আছে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কমপক্ষে ৬০ দিন ক্লাস করিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে। আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হবে ৮৪ দিন। এ লক্ষ্যে তাদের জন্য ‘কাস্টমাইজড’ সিলেবাস প্রকাশ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে এসএসসি, দাখিল ও এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষা নেওয়ার লক্ষ্যে বোর্ডগুলো প্রশ্নপত্র তৈরি করে ছাপিয়েও ফেলেছে। আর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরির কাজও শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে লকডাউন শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে গত ১৩ জুন শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ব্যাপারে বিকল্প চিন্তার কথা জানান।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পরপরই সশরীরে পরীক্ষার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়েন নীতিনির্ধারকরা। এ কারণে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া যায় কিনা সে লক্ষ্যে সুপারিশ করতে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। এর একটি ছিল উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত। এ সংক্রান্ত সুপারিশ ইতোমধ্যে তৈরি করে জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এটির আলোকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে পরীক্ষা নিতে শুরু করেছে। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ওই সুপারিশ সামনে রেখে আরেকটি কমিটি গঠন করেছে।
অনলাইনে পরীক্ষা সংক্রান্ত দ্বিতীয় কমিটি ছিল এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ব্যাপারে। বাস্তবতা বিবেচনায় সারা দেশে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে এই কমিটি সায় দেয়নি। পরে কীভাবে মূল্যায়ন করা যায় সেই পন্থা বের করতে কাজ দেওয়া হয় এই কমিটিকে। একাধিক বৈঠকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।