করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ আরও সাতদিন বাড়িয়েছে সরকার। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ১৪ জুলাই পর্যন্ত লম্বা হচ্ছে বিধিনিষেধ। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সমন্বয় অধিশাখা থেকে এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর আগে গত বুধবার ৭ জুলাই পর্যন্ত বিধিনিষেধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। সারাদেশে এখন এই বিধিনিষেধই কার্যকর রয়েছে।
সোমবার উপসচিব মো. রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, করোনাভাইরাসজনিত রোগ (কোভিড-১৯) সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় করে সব বিধি-নিষেধ ও কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে ১৪ জুলাই ২০২১ রাত ১২টা পর্যন্ত এ বিধি-নিষেধের সময়সীমা বাড়ানো হলো।
নতুন প্রজ্ঞাপনে নতুন কোনো নির্দেশনার কথা জানানো হয়নি। তাই চলমান বিধিনিষেধে যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেগুলোই কার্যকর থাকবে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হঠাৎ করেই বেড়েছে। গতকালও করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃত্যু হয়েছে ১৫৩ জনের। গত টানা আট দিন করোনায় দেশে শতাধিক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সবমিলে প্রাণহানি ছাড়িয়েছে ১৫ হাজার।
মৃত্যু বাড়ার পাশাপাশি রবিবার শনাক্তের সংখ্যাও বেড়েছে। গতকাল শনাক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৬১ জন। শনাক্তের হার ২৮.৯৯ শতাংশ। সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সারাদেশের হাসপাতালে যত করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশিই গ্রামের। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের অধিকাংশই গ্রামের। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর যখন পরিস্থিতি অনেক খারাপ হচ্ছে তখন তারা হাসপাতালে আসছেন।’
এর আগে গত ৩০ জুনের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, লকডাউন চলাকালে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। মোতায়েন থাকবে সেনাবাহিনী। এছাড়া জেলা বিজিবি, পুলিশ, র্যা ব ও আনসার সদস্যরা টহলে থাকবে। ওই প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, বিধিনিষেধ চলাকালে সব সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
সড়ক, রেল ও নৌ-পথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে শপিংমল, মার্কেটসহ সব ধরনের দোকানপাট। পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্রের দুয়ার খুলবে না। বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি, রাজনৈতিক, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ হয় এমন কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। আদালত পাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে দেয়া হবে। ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দেবে।
বিধিনিষেধ অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা যেমন- কৃষি পণ্য ও উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিরতণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা দেওয়া, রাজস্ব আদায় বিষয়ে কাজ, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবা, ব্যাংক, ফার্মেসি ও ফার্মাসিটিক্যালসসহ অন্যান্য জরুরি বা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মচারী ও যানবাহন প্রতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে চলাচল করতে পারবে।
এছাড়া পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রাক, লরি, কভার্ড ভ্যান, কার্গো ভেসেল এই বিধিনিষেধের বাইরে থাকবে। বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল বন্দরগুলো এবং তাদের অফিস বিধিনিষেধের বাইরে থাকবে। শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কেনাবেচার জন্য সময় ঠিক করে দিয়েছে সরকার। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিত্যপণ্য কেনাবেচা করা যাবে। সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন, বাজার কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। এই নির্দেশনা না মানলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অতি জরুরি প্রয়োজন বলতে বোঝানো হয়েছে, ওষুধ ও নিত্যা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা, চিকিৎসা সেবা, মৃত মানুষের দাফন বা সৎকার ইত্যাদি।
যারা করোনা ভাইরাসের টিকা নিতে বের হবেন তারা টিকা কার্ড দেখিয়ে চলাচল করতে পারবেন। খাবারের দোকান, হোটল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অনলাইনে বা পার্সেলে খাবার বিক্রি করতে পারবে। কেউ দোকানে বসে খেতে পারবে না। বিধিনিষেধ চলাকালে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের বিমান টিকিট দেখিয়ে বিমানবন্দরে যেতে পারবেন। মসজিদে নামাজ আদায়ের বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দেবে বলে জানানো হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে লকডাউন কার্যকর করার জন্য মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহলের বিষয় সম্পর্কেও বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ বিধানের অধীনে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর টহল নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় সেনা কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করে বিষিয়টি নিশ্চিত করবেন।
এছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সমন্বয় সভা করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যা ব ও আনসার নিয়োগ এবং টহলের অধিক্ষেত্র, পদ্ধতি ও সময় ঠিক করে দেবেন। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কোনো কার্যক্রমের প্রয়োজন হলে সে বিষয় পদক্ষেপ নিবেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেবেন।