আজ পহেলা জুলাই কঠোর শাট ডাউনের মাঝে শিক্ষার্থী শূণ্য ক্যাম্পাসে শততম বর্ষ উদযাপন করছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ও বাংলাদেশের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ ১০১তম বর্ষে পা রাখলো প্রতিষ্ঠানটি। ছাত্র-শিক্ষক সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে শতবর্ষ উদযাপনের মহা পরিকল্পনা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে আপাতত ভার্চুয়ালি উদযাপন করা হবে দিবসটি। তবে দেশে কোভিডের সংক্রমণ কমে আসলে আগামী নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের উপস্থিতিতে শতবর্ষ উদযাপনের পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানটির। শতবর্ষ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) অনলাইনে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মাত্র তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ এবং ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে অত্র অঞ্চলের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বাঙালির অন্যসব অর্জনের মতো প্রতিকূলতার ইতিহাস।
১৮৪৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর পুরো ভারতবর্ষেই একপ্রকার নবজাগরণ তৈরি হতে থাকে। আর এই নবজাগরণ তৈরি করেছিলো মূলতই এই অঞ্চলের শিক্ষিত সমাজ। তৎকালীন পূর্ব বাংলার এই শিক্ষিত সমাজ অনুভব করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। তাদের অনুরোধ ও বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণার ক্ষুব্ধ বাঙালি মুসলমান সমাজকে সন্তুষ্ট করতে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ওই বছরের ২৭ মে গঠিত হয় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট নাথান কমিশন। এই কমিশন ১৯১৩ সালে পূর্ব বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু বিশ্বজুড়ে চলমান ১ম বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা কিছুটা থমকে যায়। তবে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইনসভায় দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট-১৯২০ পাস হলে অবশেষে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় সাফল্য হলো একটি মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি করা। যা এই অঞ্চলের মানুষের মানস জগতে একটি স্বাধীন, প্রতিবাদী ও নিজস্ব চিন্তা ধারা তৈরি করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মুসলিম লীগের ডাকে পাকিস্তান আন্দোলনে সাড়া দেয়। পাকিস্তান আদায়ের পর ১৯৪৮ সালে যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কার্জন হল প্রাঙ্গণে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন, তখন সাথে সাথেই জিন্নাহর ভাষণের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই। শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে সংগঠিত হয়েছিলো ১৯৫২ সালের মহান মাতৃভাষা আন্দোলন । আর এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মাটিতে জোরালো হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
শুধু ভাষা আন্দোলনই নয়, বাঙালির অধিকার আদায় ও যেকোনো মানবিক বিপর্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকেই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতার আগে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল, স্বাধীনতার পরেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব বৃদ্ধিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।