ফ্রান্সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপন ফিরতে শুরু করেছে। গত ৯ জুন থেকে দেশটির প্রেক্ষাগৃহ, হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান, বুটিকসহ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে গেছে। কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে। যেন সব আগের মতো! ফলে প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু কেনা যাচ্ছে এবং রেস্তোঁরা ও ক্যাফেতে খাবারের আনন্দে মেতে উঠছেন ভোজনরসিকরা। গত ৯ জুন থেকেই অন্যান্য দেশের নাগরিকদের ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছে ফ্রান্স সরকার। তবে অতিথিদের টিকাগ্রহণ এবং বিভিন্ন দেশের করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে সব। এজন্য সবুজ, কমলা ও লাল তালিকা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। সবুজে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কোভিড ঝুঁকি কম থাকা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইসরায়েল, জাপান, লেবানন, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। কমলা তালিকায় আছে যুক্তরাজ্য।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের নাগরিকদের জন্য কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ শিথিল করেছে ফ্রান্স। সবুজ ও কমলা তালিকার দেশগুলোর দুই ডোজ টিকাগ্রহণকারীদের কোয়ারেন্টিন করতে হবে না। শুধু ফ্লাইট ছাড়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করোনা নেগেটিভ সনদ থাকলেই চলবে।
লাল তালিকায় রাখা হয়েছে করোনায় উচ্চঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, কলম্বিয়া, বাহরাইন, বলিভিয়া, চিলি, কোস্টারিকা, তুরস্ক, সুরিনাম ও উরুগুয়েকে। এসব দেশ থেকে ফ্রান্সে এলে টিকার ডোজ নেওয়ার ওপর নির্ভর করে সাত থেকে ১০ দিনের কোয়ারেন্টিন থাকতে হচ্ছে। এছাড়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা পরীক্ষার নেগেটিভ সনদ থাকা চাই। এসব কারণে লাল তালিকার দেশগুলোতে ভ্রমণে নিজ দেশের নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করছে ফ্রান্স সরকার।
দুই ডোজ টিকাগ্রহণকারী অতিথিদের জন্য ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত খুলে দিয়েছে। ফলে প্রথম সারির ব্রিটিশ ও আমেরিকান তারকাদের পা পড়বে কানসৈকতে। যেমন অভিনেত্রী-পরিচালক জোডি ফস্টার সম্মানসূচক স্বর্ণ পাম গ্রহণ করতে আসছেন। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অন্যান্যবারের মতো মে মাসে উৎসবটি হয়নি। শেষ পর্যন্ত জুলাইয়ে ফিরে আসছে সেই জৌলুস। ৭৪তম কান উৎসবের পর্দা উঠবে ৬ জুলাই। চলবে টানা ১২ দিন। সবাইকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিতে পেরে বেজায় খুশি আয়োজকরা। তাদের আশা, কানের সুন্দর প্রত্যাবর্তন উপভোগ করা যাবে।
সারা ফ্রান্সের মধ্যে এখন ফরাসি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কিছু অংশসহ দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সে আল্পে-মারিটিম বিভাগে কোভিড-১৯ শনাক্তের হার সবচেয়ে কম! তবুও ফ্রান্স ও কানে বিশেষ করে উৎসবের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রোটোকল প্রকাশ করেছে আয়োজকরা। উৎসব কর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন, প্রত্যেকের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেবেন তারা। এজন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ব্যবস্থা এবং সুরক্ষা প্রোটোকল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী মানিয়ে চলতে এবং ছবিবাজারের প্রোটোকল কানের স্থানীয় ও ফ্রান্সের জাতীয় নির্দেশিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উৎসবের সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো জেনে নেওয়া যাক।
কোভিড-১৯ পরীক্ষা
পালে দে ফেস্টিভাল ভবনের কাছেই পন্তিয়েরো এসপ্লানাদে কান চলচ্চিত্র উৎসব এবং মার্শে দ্যু ফিল্মের পক্ষ থেকে করোনা পরীক্ষার বিশেষায়িত ল্যাব থাকছে। ৫ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকবে। ফরাসি ও অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণকারীরা বিনামূল্যে এখানে নমুনা পরীক্ষা করাতে পারবেন। তবে তার আগে ইজি কোভিড বায়ো গ্রুপ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নাম নিবন্ধন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। গতকাল থেকে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার ফল ছয় ঘণ্টার মধ্যে অংশগ্রহণকারীর ইমেইলে চলে আসবে। পরীক্ষাগারটিতে দ্রুত সময়ের মধ্যেও পিসিআর পরীক্ষা করানো যাবে। ফলে ৩০ মিনিটের মধ্যে ফল চলে আসবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেককে গুনতে হবে ৫০ ইউরো (৫ হাজার ৫৩ টাকা)। অ্যান্টিজেনিক পরীক্ষা যে কেউ চাইলে স্থানীয় ফার্মেসিগুলোতেও করানো যাবে। এক্ষেত্রেও পড়বে ৫০ ইউরো।
পালে দে ফেস্টিভাল ভবনে প্রবেশ
ইউরোপীয় ইউনিয়ন অধিভুক্ত দেশ থেকে এলে করোনা প্রতিরোধক টিকার দুই ডোজ নেওয়ার সনদ দেখালে কান উৎসবের প্রাণকেন্দ্র পালে দে ফেস্টিভাল ভবনে ঢোকা যাবে। অথবা ১৫ দিন আগে থেকে ছয় মাস সময়ের মধ্যে অ্যান্টিবডি থাকার সনদ থাকতে হবে। এছাড়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইস্যু করা একটি নেগেটিভ পিসিআর পরীক্ষার ফল থাকলেও চলবে। প্রতিটি ডকুমেন্ট কিউআর কোড আকারে উপস্থাপন করতে হবে। এজন্য গুগল প্লে ও অ্যাপ স্টোর থেকে সরকারি অ্যাপ্লিকেশন ‘তু অ্যান্টি কোভিড’ ডাউনলোড করতে হবে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর প্রেক্ষাগৃহের বেলায় অবশ্য এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
পালে দে ফেস্টিভাল ভবনের অভ্যন্তর
স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পালে দে ফেস্টিভাল একটি আন্তর্জাতিক উদাহরণ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, জীবাণুমুক্ত ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসহ কঠোর প্রোটোকল মেনে চলায় পালে দে ফেস্টিভাল পেয়েছে গ্লোবাল বায়োরিস্ক অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের ‘জিবিএসি স্টারটিএম ফ্যাসিলিটি’ স্বীকৃতি। এবারের উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা যেন চারপাশে নিরাপদ পরিবেশ পায় সেজন্য সব ভেন্যু ও ছবিবাজারে (মার্শে দ্যু ফিল্ম) স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে প্রয়োজনীয় সমস্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।
** পালে দে ফেস্টিভালে স্থাপিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, এটি ফ্রান্সের জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উৎসব চলাকালে বায়ুচলাচল স্বাভাবিক রাখতে এয়ার কন্ডিশনার ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে।
** পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সংস্পর্শে আসার কেন্দ্রগুলো নিরাপদ রাখতে নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে করা হবে।
** এবারের আসরে যতটা সম্ভব ডিজিটালাইজেশনে গুরুত্ব দেওয়া হবে। হাতের সংস্পর্শ এবং যেকোনো ধরনের জিনিসপত্র আদান-প্রদান সীমিত থাকবে। টিকিটের জন্য অগ্রিম বুকিং ব্যবস্থার পাশাপাশি বেশিরভাগ প্রকাশনা ডিজিটাল মিডিয়ায় স্থানান্তর করা হচ্ছে।
** উৎসবের ভেন্যুগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
মাস্ক বাধ্যতামূলক
ফ্রান্সের নিয়ম অনুযায়ী, দোকানের ভেতরে এবং রেস্তোরাঁয় ঢোকা ও বের হওয়ার সময় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। ফলে পালে দে ফেস্টিভাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, হোটেলের অভ্যন্তর, অন্যান্য জমায়েতের স্থানসহ পুরো উৎসবে মাস্ক বাধ্যতামূলক। লালগালিচায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য। মাস্ক অবশ্যই সার্জিক্যাল, এফএফপিটু বা এএনএফওআর ক্যাটাগরি ওয়ানের মান অনুযায়ী ৯০ শতাংশ পরিস্রাবণ উপযোগী মানসম্পন্ন কাপড়ের হতে হবে। উৎসব এলাকায় প্রবেশের সময় পরিচয় যাচাইয়ের জন্য ক্ষণিকের জন্য মাস্ক সরানোর জন্য বলা হতে পারে।
স্বাস্থ্যবিধি
মাস্ক ব্যবহার ছাড়াও সবার সুরক্ষা নিশ্চিতে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছেন উৎসব আয়োজকরা।
** নিয়মিত হাত পরিষ্কার রাখতে উৎসব এলাকার সর্বত্র স্যানিটাইজিং স্প্রে কিংবা জেল থাকবে।
** হাঁচি-কাশি এলে কনুই বা টিস্যু দিয়ে মুখ ঢাকতে হবে।
** একবার ব্যবহার উপযোগী টিস্যু কাজে লাগিয়ে এরপর ফেলে দিতে হবে।
** হাত মেলানো ও কোলাকুলির মতো সংস্পর্শ ছাড়া একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাতে হবে।
** পালে দে ফেস্টিভাল ভবনে কিংবা প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের জন্য মেঝেতে দেওয়া এক মিটার দূরত্ব রাখার চিহ্ন অনুযায়ী সারি বেঁধে দাঁড়াতে হবে।
উৎসবে চিকিৎসা সেবা
করোনা উপসর্গ কিংবা অন্যান্য জটিলতা দেখা দেওয়া ব্যক্তিদের সহায়তায় উৎসব অঞ্চলে সার্বক্ষণিক একটি মেডিক্যাল ইউনিট থাকবে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ উপসর্গ থাকলে আইসোলেশন রুম দেবে ইউনিটটি। এছাড়া করোনা চিকিৎসার অনুমোদিত একটি টিম দায়িত্ব পালন করবে।
উৎসবে অংশগ্রহণকারী সবার জন্য দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অনলাইনে মেডিক্যাল সেবা থাকবে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ উপসর্গের ক্ষেত্রে কনসিলিও মেডিকেল কনসিয়ার্জ কয়েকটি পদক্ষেপ নেবে। যেমন:
** একঘণ্টার মধ্যে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে এবং ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে মেডিকেল টেলিকনসালটেশন ব্যবস্থা করে দেওয়া।
** কানের স্থানীয় চিকিৎসক ও মেডিক্যাল সেন্টারের সুপারিশ এনে দেওয়া।
** কানে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুত অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া।
পরিবহন
** কানের কাছের বিমানবন্দর নিস কোত দাজুর করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় সফল হওয়ায় এসিআই এয়ারপোর্ট হেলথ অ্যাক্রেডিটেশন পেয়েছে।
** জনসাধারণের স্বাস্থ্যসুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য ট্রেন স্টেশনগুলো সুরক্ষিত রেখে কার্যক্রম পরিচালনার পদক্ষেপ নিয়েছে ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় রেলওয়ে প্রতিষ্ঠান এসএনসিএফ।
** ট্যাক্সিতে নিয়মিতভাবে বায়ুচলাচল স্বাভাবিক ও জীবাণুমুক্ত রাখা হচ্ছে।
** বাসে যাত্রী ও চালকদের জন্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা রয়েছে।
হোটেল
কানের প্রতিটি হোটেল ইউনিয়ন অব হোটেল ট্রেডস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ইউএমআইএইচ) কঠোর স্যানিটারি প্রোটোকল প্রয়োগ করছে। এর মধ্যে রয়েছে জীবাণুমুক্ত কক্ষ, বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী, সামাজিক দূরত্ব বজায়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
আয়োজকরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, স্বাস্থ্যসুরক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও উৎসবে ও ছবিবাজারে অংশগ্রহণকারীরা সচেতন না থাকলে ফল পাওয়া যাবে না। সবার সম্মিলিত দায়বদ্ধতার মধ্যে এর কার্যকারিতা নির্ভর করছে। একদিকে যেমন স্যানিটারি প্রোটোকল প্রয়োজন; তেমনই কারও জ্বর, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, পেশী ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, খাবারের স্বাদ বা গন্ধ হ্রাস পাওয়ার উপসর্গ থাকলে উৎসব প্রাঙ্গণে না ঢুকে দ্রুত চিকিৎসা সেবা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আয়োজকরা। নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ও উৎসবমুখর আয়োজনে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রকর্মী, সংবাদকর্মী ও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের স্বাগত জানাতে আপাতত উন্মুখ আয়োজকরা!