চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সগুলো আন্তর্জাতিক মানের নয়। বিভিন্ন ট্রেড কোর্সের ডিগ্রি দেওয়া হলেও চাকরির বাজারে এসব ডিগ্রির বিপরীতে পদ সৃষ্টি হচ্ছে না। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী কোর্স করেও চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারছেন না। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন কারিগরি শিক্ষার্থীরা। তবে, সুখবর হচ্ছে এ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স বদলে যাবে। আধুনিক ও বিশ্বমানের হবে চার বছর মেয়াদি কারিগরি শিক্ষা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ উপযোগী কারিকুলাম হবে। এটি যুগোপযোগী করতে গত ২৪ মে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে একটি সভা হয়।
সভায় কারিকুলাম পরিবর্তনের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয় এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে দ্রুত তা চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সভায় কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়নে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। এক, আধুনিক সিলেবাস প্রণয়ন; দুই. শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা; তিন. ল্যাবগুলোকে আধুনিক করা। এ তিনটি বিষয়ে কাজ শুরু করেছে কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ, কারিগরি অধিদফতর ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ড।
এসব পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি) মো. মহসিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কারিগরি ট্রেডে বিভিন্ন কোর্স নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী কোর্স শেষ করলেও এ সংক্রান্ত পদ সৃষ্টি না হওয়ায় চাকরি পাচ্ছে না। কারিগরি শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য অনেকগুলো ট্রেড ভেঙে একাধিক নতুন ট্রেড করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাকরির বিধি অনেক পুরাতন। চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে নতুন ট্রেডগুলো উল্লেখ না থাকায় শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন না। ট্রেড কোর্সগুলো পুনর্বিন্যাস করে গত ২৪ মে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সামনে উপস্থাপন করা হয়।
জানা গেছে, চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন পদের জন্য আবেদন করলে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। নতুন ট্রেডের শিক্ষার্থীদের আবেদনের সুযোগ দিলে পুরাতন ট্রেডের চাকরিপ্রত্যাশীরা বিরোধিতা করেন। নতুন ট্রেডে পাস করা শিক্ষার্থীদের সুযোগ না দিলে তারা আন্দোলন করেন। উভয় সমস্যা সমাধানের জন্য ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাক্রমের বিদ্যমান টেকনোলজিগুলো মূল টেকনোলজির সঙ্গে সমন্বয় করে পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে একবার সভা হয়েছে। শিগগিরই সেটি চূড়ান্ত করা হবে।
যেসব পরিবর্তন আসছে
বর্তমানে দেশে মূল টেকনোলজি আছে ১০টি (ট্রেড) আর ইম্যাজিন টেকনোলজি রয়েছে ৩৩টি (সাব ট্রেড)। ইম্যাজিন টেকনোলজিতে উত্তীর্ণ ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে আবেদনের সুযোগ নেই। বিভিন্ন টেকনোলজি থেকে উত্তীর্ণ ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে একটি কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা হিসেবে রূপান্তরের লক্ষ্যে এটিভিকিউএফ এলিগেন্ট নেই। বিভিন্ন ইম্যাজিন টেকনোলজির এটিভিকিউএফ-এ অন্তর্ভুক্ত করতে সমস্যা রয়েছে। ইম্যাজিন টেকনোলজিতে শিক্ষক, ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। ফলে কারিগরি শিক্ষায় শিল্পের সংযুক্তির সুযোগ কম। এর মধ্যে ১০টি মূল টেকনোলজিকে (ট্রেড) ভেঙে ৩৩টি ইম্যাজিন টেকনোলজিতে (সাব ট্রেড) ভাগ করায় শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষে চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার শিকার হচ্ছেন।
মূল টেকনোলজিগুলোর সঙ্গে ইম্যাজিন টেকনোলজির ৬৫ শতাংশ মিল থাকলে আলাদা সনদ দেওয়া হবে। এর কম মিল থাকলে মেকআপ কোর্স করতে হবে। এসব শিক্ষার্থীর সনদে বিশেষ যোগ্যতা উল্লেখ করে দেওয়া হবে। এছাড়া শিক্ষক, ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতির সমস্যায় ধুকছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলো। কারিগরি শিক্ষাকে কর্মসংস্থান শিক্ষা হিসেবে রূপান্তরের লক্ষ্যে এসব সমস্যা সমাধানেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ৩৩টি ইম্যাজিন টেকনোলজির ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেওয়া হয়। ডিগ্রি দেওয়া হলেও চাকরির বাজারে পদ সৃষ্টি করা হয়নি। যেমন- হাসপাতালে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় সেগুলো মেরামত করবেন ইলেকট্রো মেডিকেল বিষয়ে ডিগ্রিধারীরা। কিন্তু কোনো হাসপাতালে এ পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে একদিকে ডিগ্রিধারীদের চাকরি হচ্ছে না, অন্যদিকে যন্ত্র নষ্ট হলে তা পড়ে থাকে।
যেমন- পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেড ভেঙে এনভায়রনমেন্ট ট্রেড আর ইলেকট্রনিক্স ভেঙে ইলেকট্রো মেডিকেল ট্রেড চালু করা হয়েছে। মূল ট্রেডের সিলেবাস একই। ইলেকট্রো মেডিকেল ও এনভায়রনমেন্ট ট্রেডের শিক্ষার্থীদের মূল ট্রেডের বাইরে নিজের বিষয়ে বাড়তি পড়তে হয়। কিন্তু চাকরির সার্কুলারে চাওয়া হয় সিভিল বা ইলেকট্রনিক্স ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস। তখন ইলেকট্রো মেডিকেল ও এনভায়রনমেন্ট ট্রেড- এ দুই বিষয়ের ডিগ্রিধারীরা আবেদন করতে পারেন না। ইম্যাজিন টেকনোলজিগুলো মূল টেকনোলজির সঙ্গে সমন্বয় করা হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইম্যাজিন টেকনোলজিতে পাস করা শিক্ষার্থীদের সনদে বিশেষ যোগ্যতা লিখে দেওয়া হবে। ইলেকট্রো মেডিকেল ট্রেড থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের সিটি স্ক্যান, ইসিজি, এক্সরে মেশিনসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ মেরামতের জন্য চাকরির সুযোগ পাবেন।
ইম্যাজিন টেকনোলজিগুলোকে মূল টেকনোলজির সঙ্গে অ্যালাউড গ্রুপে বিন্যস্ত করতে একটি রোড ম্যাপ তৈরি করেছে মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, মূল টেকনোলজি হবে সিভিলের সমতুল্য। অ্যালাইড গ্রুপের টেকনোলজি হবে- সিভিল, সিভিল (উড), কন্সট্রাকশন ও এনভায়রনমেন্টাল। মূল টেকনোলজির সঙ্গে সিভিলের শতভাগ, সিভিল (উড) ৮৪ দশমিক ৮৩ ভাগ, কন্সট্রাকশনের ৮৯ দশমিকর ৪১ ভাগ ও এনভায়রনমেন্টালের ৬৬ দশমিক ৯০ ভাগ মিল আছে।
মেকানিক্যাল টেকনোলজি ভেঙে ছয়টি ইম্যাজিন টেকনোলজি করা হয়েছে। এগুলো হলো- মেকানিক্যাল, মেকাট্রনিক্স, পাওয়ার, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং, অটোমোবাইল ও মাইনিং অ্যান্ড মাইন সার্ভে। মূল টেকনোলজি মেকানিক্যালের সঙ্গে মেকাট্রনিক্সের ৭০ দশমিক ৪৭ ভাগ, পাওয়ারের ৫১ দশমিক শূন্য এক ভাগ, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিংয়ের ৪৮ দশমিক ৯৯ ভাগ, অটোমোবাইল ও মাইনিং অ্যান্ড মাইন সার্ভের ৬৩ দশমিক শূন্য নয় ভাগ। মূল টেকনোলজির সঙ্গে ৬৫ শতাংশের কম মিল থাকায় পাওয়ার, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং, অটোমোবাইল ও মাইনিং অ্যান্ড মাইন সার্ভের শিক্ষার্থীদের মেকআপ কোর্স করতে হবে।
মেরিন টেকনোলজিকে তিনটি ইম্যাজিন টেকনোলজিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- মেরিন, শিপবিল্ডিং ও নটিক্যাল অ্যান্ড মাইন সার্ভে। শিপবিল্ডিংয়ের সঙ্গে মূল টেকনোলজির ৭২ দশমিক ৪৮ ভাগ মিল রয়েছে। আর নটিক্যাল অ্যান্ড মাইন সার্ভের সিলেবাস তৈরির কাজ চলছে।
কেমিক্যাল টেকনোলজিকে ভেঙে চারটি ইম্যাজিন টেকনোলজিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- কেমিক্যাল, গ্লাস, সিরামিক্স ও ফুড। এর মধ্যে মূল টেকনোলজির সঙ্গে গ্লাসের ৪১ দশমিক ৬১ ভাগ, সিরামিক্সের ৪৩ দশমিক শূন্য পাঁচ ভাগ এবং ফুডের ৫২ দশমিক শূন্য এক ভাগের মিল আছে। গ্যাস, সিরামিক্স ও ফুড টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের মেকআপ কোর্স বাড়তি পড়তে হবে।
এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স টেকনোলজিকে দুটি ইম্যাজিন টেকনোলজিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স (অ্যারোস্পেস) ও এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স (এভিয়নিক্স)। মূল টেকনোলজির সঙ্গে ইম্যাজিন টেকনোলজি দুটির যথাক্রমে শতভাগ ও ৭০ ভাগ মিল রয়েছে।
লেদার টেকনোলজিকে ভেঙে লেদার, লেদার প্রডাক্ট অ্যান্ড এক্সেসরিজ ও ফুটওয়্যার ইম্যাজিন টেকনোলজিতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ফুটওয়্যার টেকনোলজিটি চালু রয়েছে। বাকিগুলোর শিক্ষাকার্যক্রম এখনও চালু হয়নি।