চলতি দফায় করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকলে কলিগরা হোম অফিস করছিলেন। আমি আর নির্বাহী সম্পাদক পলাশ মাহবুব মাঝে মধ্যে অফিসে যাই। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাই। তেমনি এক নিয়মিত সন্ধ্যা। তখন সন্ধ্যা ৭টা ২৫ ই হবে। কারণ ২ মিনিট আগে ৭ টা ২৩ এ মেয়ে ফোন করেছিলো তাকে বলেছিলাম জরুরি একটা কাজ করছি। ফ্রি হয়ে ফোন দিচ্ছি। কাজটিই করছিলাম কম্পিউটারে মাথা ডুবিয়ে। এমন সময় বাইরে বিকট শব্দ। কিছু বোঝার আগেই সামনের কম্পিউটারটি উল্টে পড়ে গেলো। পেছনে জানালার কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ পেলাম। বিদ্যুৎ চলে গেলো। আমরা অন্ধকারে ডুবে গেলাম। আমাদের অফিস এক্সিকিউটিভ সুবল দাসও ছিলেন।
এরপর অন্ধকারের কারণে টেবিল হাতড়ে ফোনটি হাতে নিলাম। মোবাইলের আলো যা সামান্য পেলাম। তাতে আমরা দরজার পথ খুঁজে নিলাম। দ্রুত দরজা পথে এগিয়ে গিয়ে ভাবতে পারছিলাম না- কোন দিকে যাবো- ছাদে নাকি, নিচে? তিন তলা ভবনটির তৃতীয় তলাতেই আমাদের অপরাজেয়বাংলা.কম’র অফিস। ঠিক তিন তলা বলা যাবেনা। আড়াই তলা। কারণ অফিস ফ্লোরটি থেকে সিড়িতে আরেকটি ফ্লাইট উঠলে আরেকটি অফিস।
পলাশ দেখলাম সিঁড়ি পথে নিচে পা বাড়ালো। সুবল একটু এগিয়ে গেলো। আমার পেছনে তিন তলার অপর অফিসেরও কিছু মানুষ। তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। প্যানডেমিকে এই অফিসে আগে যারা ছিলেন তাদের ব্যবসা গুটিয়ে দিতে হয়েছে। নতুন একটি অফিস খুলেছে, কম্পিউটার সফটওয়্যার রিলেটেড কিছু একটা নাম হবে। এখন মনে পড়ছে না। দিন কয়েক হয়েছে তাদের অফিস হয়েছে, ফলে পরিচয়টিও করে ওঠা হয়নি। ভবনটিতে গোটা চারেক অফিস ছিলো। প্যানডেমিকে তার সব কটিই প্রায় বন্ধ। আসা-যাওয়ার পথে যাদের দেখতাম তাতে অপরাজেয়বাংলাসহ দুটি অফিসই সচল ছিলো। বাড়িওয়ালার এসে মাঝে মধ্যে বসতেন দোতলার একটি ছোট রুমে। আর নিচ তলায় সিড়ি ঘরের পাশে একটি কক্ষে কেয়ারটেকার থাকতেন।
যাই হোক সেই সিঁড়ি পথেই আমরা নিচে নামতে শুরু করলাম। পলাশ মাহবুব আমাকে ডেকে চলেছে, আমি সুবল কে ডাকছি। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের ক্ষীণ আলোতে পথ খুজছিলাম। নাকে লাগছিলো ধোঁয়ার তীব্র গন্ধ। একটা ফ্লাইট নেমেই আমরা তীব্র ধোঁয়ার মধ্যে পড়ে গেলাম। মাথা কাজ করছিলো নিচের দিকে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু মানুষের এমনই কিন্তু হয় বিপদে, আপনি জানবেন না আপনি কি করছেন? আর পরে মনে হবে এমনটা করেছিলাম বলেই বিপদটা বেড়েছে। অথবা এই কারণেই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছি। প্রকৃতিই নির্ধারণ করে আপনি কোন দিকে যাবেন! আমি পলাশকে হেঁকে হেঁকে বলে চলেছি- পলাশ ধোঁয়া ইনহেল করিস না। শ্বাসবন্ধ রেখে এগুতে থাক। পলাশ আমার সামনে ছিলো। বললো আর যাবো কি করে সিড়িতো বন্ধ। এবার?
গরম ধোঁয়া। আমরা সেটাই ইনহেল করছি। পলাশ পিছিয়ে গেলো সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকা ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে আমিই পথ খুঁজে নিলাম। বাইরে থেকে আসা কিছুটা আলোর সহায়তায়। একট বড় রেলিংয়ের অংশ পড়ে ছিলো তার উপর দিয়ে নিজেকে হড়কে দিলাম। কিছুটা পিছলে নিচে নেমে আসলাম। এরপর গ্যারেজের দিকটা পেরিয়ে কেমন করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এখানে আবিষ্কার করলাম পলাশ ও সুবল আমার পাশেই আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাশে ফিরতেই দেখি একজনের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে খোঁজ নিতে যাবো, দেখলাম রাস্তার ওপর দুজন পড়ে রয়েছে। সামনে এগুতে দেখি আরও কয়েকজন কাতরাচ্ছে।
মানুষের দুর্দশা দেখে তার খবর নিতে যাবো এমন সময় গাড়ির আলোয় তখনই চোখে পড়লো পলাশের মাথা থেকে রক্ত ঝড়ছে। এবার ঘাবড়ে গেলাম। বললাম দ্রুত চল, কাছে ধারে ফার্মেসি আছে কি-না দেখি। আমরা এগিয়ে গেলাম আদ-দ্বিন হাসপাতালের দিকে। সেখানে যেতে যেতে দেখি রাস্তায় আরও মানুষ পড়ে কাতরাচ্ছে। তার মধ্য দিয়েই নিজেরা এগিয়ে গেলাম। একটি ফার্মেসিতে ঢুকে পলাশের মাথার রক্ত দেখছি। ও বললো, আপনার গাল থেকেও তো রক্ত ঝড়ছে। বাম হাতে নিজেই দেখি ছোট একটি রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। ডান হাতের মধ্যমার মাথায় একটা কাচ ফুটে আছে। আস্তে সেটা তুলতে রক্ত বেরিয়ে এলো। ফার্মেসির একজন হাতে একটি স্ট্রিপ ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আপনাদের হাসপাতালে যাওয়া উচিত।
মাস্কগুলোও অফিসে ফেলে এসেছি। দ্রুত মাস্ক কিনে তিনজনই পরে নিলাম। এদিকে আলোতে দেখলাম সুবলের তেমন কিছু হয়নি। অফিস কক্ষে যে দিকে জানালা ভেঙ্গেছে সেদিকটা থেকে সবচেয়ে দূরেই ছিলো সুবল। ফলে ও রক্ষা পেয়েছে বোধ হয়। তবে তার পায়ে একটি চটি। ওকে বললাম, তুমি এদিকটায় থাকো, আমরা হাসপাতালে যাই। ততক্ষণে একেকজনকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো আদ-দ্বিন হাসপাতালের দিকে।
আমরা হলি ফ্যামিলিতে যাবো সাব্যস্ত করে বাসায় স্ত্রীকে ফোন করে সেটা জানিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রিক্সাগুলোও ততক্ষণে রাস্তা থেকে উধাও। আমরা হাঁটতে হাটতে মগবাজার পর্যন্ত যেতে সিদ্ধান্ত নিলাম আল-বারাকাহ হাসপাতালে যাই। দ্রুত হেঁটে দুজন সেদিকেই গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ডজন খানেক মানুষ সেখানেও পৌঁছে গেছে। ইমার্জেন্সিতে ভির। সকলেই রক্তাক্ত। একটি ১৬-১৭ বছর বয়সের কিশোর সিকিউরিটির পোশাক পরা। একটি চেয়ারে মাথা এলিয়ে পড়ে আছে। এখানে মনে হলো, আমাদের নয়, এদেরই চিকিৎসা আগে দরকার। দায়িত্বরত চিকিৎসক পলাশের মাথায় একটি ছোট ড্রেসিং করে দিলেন। আমাকে দেখে পরামর্শ দিলেন বাসায় গিয়ে ব্রাশ দিয়ে কাচগুলো সরিয়ে, ভেতরে কাচ ঢুকে গেলে সেগুলো তুলে আনার। যেহেতু দৃশ্যত আমরা ভালোই ছিলাম। পলাশকে বাসায় পাঠিয়ে আমিও বাসায় চলে গেলাম। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রাতে মাথার চুল ফেলে কাচ তুলে, টিটেনাস ইনজেকশন নিয়ে তবে ঘুমিয়েছি।