দলটা নিজেদের প্রথম ম্যাচে হারিয়েছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনকে। এরপরের দুই ম্যাচে হেরে ছিল বিদায়ের খুব কাছে। সেই ডেনমার্ক শেষ আটে যাবে, তখন এ কথায় বিশ্বাস করতেন আপনি? তখন অবিশ্বাস্য ঠেকা বিষয়টাকেই বাস্তবতায় রূপ দিয়েছে ডেনমার্ক।
রাশিয়ার পর গেলবারের সেমিফাইনালিস্ট ওয়েলসের জালেও জড়িয়েছে চার গোল। ৪-০ গোলের এই জয়ে ড্যানিশরা রূপকথা রচনা করে দিয়ে পৌঁছে গেছে ইউরো ২০২০ এর শেষ আটে। ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’-একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে। এতদিন যদি তাতে আপনি বিশ্বাস করে থাকেন তাহলে আজকের ম্যাচটা আপনাকে তার ওপর সন্দেহ পোষণ করতে বাধ্য করাবে।
শুরুর বিশ মিনিট সময় ওয়েলস ডেনমার্কের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে ছিল রীতিমতো। ডান পাশ দিয়ে ফুলব্যাক কনর রবার্টস উঠে যাচ্ছিলেন হরহামেশাই, যা গ্যারেথ বেলকে রাইট উইং থেকে ভেতরে এসে শক্তিশালী বাম পা ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছিল। নবম মিনিটে ম্যাচের প্রথম শটটাও এল সেই যুগলবন্দিতেই। যদিও বেলের সেই শটটা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
এরপরের আক্রমণেও ছিল বেলের ছোঁয়া। রবার্টসের পাস তার পা হয়ে পৌঁছায় ডেনমার্ক বিপদসীমার একটু বাইরে, অ্যারন রামসের পায়ে। তার শট ডেনমার্ক রক্ষণে পায় বড় একটা ডিফ্লেকশন, যদিও পরে স্মেইকেলের বিশ্বস্ত হাতে জমা পড়ে বল, রক্ষা মেলে ড্যানিশদের। ম্যাচে ওয়েলসের সুখস্মৃতি সে পর্যন্তই। এতক্ষণ মুহুর্মুহু ওয়েলস আক্রমণে কিছুটা দিশেহারা ড্যানিশরা এরপরই নিজেদের গুছিয়ে নেয়। আক্রমণে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে।
প্রথম গোলটাও এল সেই থেকেই। ২৭ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে ক্যাসপার ডলবার্গের করা দারুণ এক শট ওয়েলস গোলরক্ষক ড্যানি ওয়ার্ডকে কোনো সুযোগ না দিয়েই জড়ায় জালে। এই ইয়োহান ক্রুইফ অ্যারেনায় আয়াক্স অ্যামস্টারডামের হয়ে ২৩ গোল করেছেন ডলবার্গ। তবে সে সবগুলোর চেয়েও ঢের গুরুত্বপূর্ণ গোল নিশ্চিতভাবেই ছিল এটা, যা এগিয়ে দেয় ড্যানিশদের।
এরপর থেকে ম্যাচের লাগামটাও চলে গেছে ড্যানিশদের কাছেই। প্রথম গোলের কয়েক মিনিট পর দ্বিতীয়টাও পেয়েই যাচ্ছিল ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের দল। জোয়াকিম মায়েহলার নিচু ক্রসটা যদি ঠিকঠাক পায়ে জমাতে পারতেন ডলবার্গ, তাহলে ওয়েলসের আশা শেষ হয়ে যেতে পারত সেখানেই।
সে যাত্রায় গোল না হলেও ওয়েলসের যা সম্ভাবনা ছিল, শেষ হয়ে গেছে প্রথমার্ধের শেষ দিকে। মাঝমাঠ থেকে বাড়ানো বল পা বাড়িয়ে আয়ত্তে নিতে চেয়েও পারেননি রবার্টস, কুঁচকির চোট নিয়ে উলটো মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। প্রথমার্ধে এই রবার্টসই ছিলেন বেল আর র্যামসের পর ‘স্বাগতিক’দের সবচেয়ে কার্যকর খেলোয়াড়, সেই তাকেই হারিয়ে বিপদে পড়ে ওয়েলস।
তাকে তুলে যাকে নামানো হলো, সেই নিকো উইলিয়ামসের ভুলেই দলটা হজম করল দ্বিতীয় গোলটা। ডান প্রান্ত থেকে বার্সেলোনা স্ট্রাইকার মার্টিন ব্র্যাথওয়েটের শট কোনোরকমে বিপদমুক্ত করতে চেয়েছিলেন উইলিয়ামস, কিন্তু পারেননি; বলটা গিয়ে পড়ে ডলবার্গের পায়ে, সেখান থেকে তার আগুনে শট, আর গোল। প্রথমার্ধে যে দ্বিতীয় গোলটা পেতে পেতেও পাননি, সেটাই ক্যাসপার ডলবার্গ পেয়ে যান ম্যাচের ৪৮ মিনিটে। এক গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যাওয়া ডেনমার্ক ব্যবধান করে দুই গুণ।
ম্যাচে ফেরার লক্ষ্যে এরপর থেকে ওয়েলস আক্রমণ চালিয়ে গেছে শেষতক। তবে সে সবই ড্যানিশ রক্ষণ সামলেছে ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তায়। উলটো শেষদিকে ওয়েলসের জালে জড়িয়েছে আরও দুই গোল। ৮৭ মিনিটে ডানপাশ থেকে ইয়েনসেনের ক্রস থেকে বল আসে জোয়াকিম মায়েহলার পায়ে, তারপর তার এক আগুনে শটে ব্যবধান ৩-০ করে দলটি।
ওয়েলশম্যানদের কফিনে শেষ পেরেকটা এরপর ঠুকেছেন মার্টিন ব্র্যাথওয়েট। তবে গোল উদযাপনের আসল স্বাদটা কি পেয়েছিলেন? এক মিনিট মতো যে তার উদযাপনের পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল ভিএআর! তবে এরপরই এসেছে নিশ্চয়তা। গোলের উদযাপন তো বটেই, দুরন্ত জয়ের উচ্ছ্বাসটাই যেন ছিল ব্র্যাথওয়েটের কাছে তার চেয়ে বেশি। সঙ্গে উৎসবে মেতেছে দল।
নিজেদের প্রাণভোমরাকে প্রথম ম্যাচেই ‘হারানোর’ আপদ ছিল ডেনমার্কের। ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন সেদিন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মাঠ ছেড়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছেন বটে; কিন্তু তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন ডেনমার্কের অনুপ্রেরণা হয়েই। সে অনুপ্রেরণা না হলে কি আর প্রথম দুই ম্যাচ হেরেও এভাবে শেষ আটে ওঠে ডেনমার্ক?
কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা হয়ে গেছে। প্রতিপক্ষ হিসেবে আসতে পারে নেদারল্যান্ডস কিংবা চেক প্রজাতন্ত্রের কেউ। সেখানেও হবে নাকি আরেকপ্রস্থ ‘ড্যানিশ রূপকথা’?