দেশের মধ্যে গেল তিন সপ্তাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় সর্বোচ্চ সংক্রমণ থাকলেও তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেখানে শনাক্তের হার ৭০ শতাংশের কাছাকাছি উঠে গিয়েছিল, তা এখন ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। খুলনা ছাড়া অন্য অনেক এলাকার অবস্থাই এখন ভালোর দিকে। ওই সব এলাকায় সংক্রমণ যখন চূড়ায়, তখন ঢাকায় সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু এখন সীমান্ত এলাকায় অবস্থা ভালোর দিকে গেলেও ঢাকায় দ্রুত বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।
গত সপ্তাহে যেখানে ঢাকায় দৈনিক শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশ, তা এখন ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে দেশে গড় হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে শনাক্ত বেড়েছে ৫৫.১৬ শতাংশ এবং মৃত্যু বেড়েছে ৪৬.৩০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা এমন পরিস্থিতিকে ঢাকার জন্য আবারও বিপজ্জনক অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, ঢাকায় এই সংক্রমণ বিস্তার মানেই দেশে আবারও গত বছরের জুন কিংবা চলতি বছরের এপ্রিলের চেয়েও ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে যাওয়ার আশঙ্কা। কেউ কেউ আরো পরিষ্কার করে বলছেন, আগামী সপ্তাহ থেকে পরবর্তী তিন সপ্তাহে ঢাকার জন্য বড় বিপদ আসছে। এ ক্ষেত্রে ডেল্টা ভেরিয়েন্টকে দায়ী করা হচ্ছে বেশি। সঙ্গে আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট ও পুরনো ভেরিয়েন্টও রয়েছে। অর্থাৎ একাধারে তিন ভেরিয়েন্টের কবলে ঢাকা বিপর্যস্ত হওয়ার মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কিছুদিন ধরেই ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা এবং ঢাকার বাইরে উচ্চ সংক্রমিত এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে এবার এমন মাসুল দিতে হবে, বলছেন কেউ কেউ। এ অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পেতে হলে এখনই আবার ঢাকায় যাতায়াত কমপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিস্থিতির তো অবনতি ঘটাই স্বাভাবিক। আমরা কেউ তো স্বাস্থ্যবিধি মানছি না। সবার আচরণ যেন একেবারেই স্বাভাবিক। বিধি-নিষেধও ঢিলেঢালা। পথে-ঘাটে যে অবস্থা দেখা যায় সেটা খুবই দুঃখজনক ও বিপজ্জনক। সামনে তো ভয়ংকর পরিণতি ঘটতেই পারে।’ তিনি বলেন, ‘এখনই সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন জরুরি। যাতায়াত, মার্কেট ও রেস্টুরেন্ট নিয়ন্ত্রণ না করলে পরিণতি খুবই খারাপ হবে।’
প্রায় একই মত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেনের। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার পরিস্থিতি কিন্তু আবার খারাপ হয়ে পড়ছে দ্রুত। এবার যেভাবে দ্রুত শনাক্তের হার বাড়ছে, তা কিন্তু আগে হয়নি। আগে গতি ছিল ধীর কিন্তু এবার দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। তিনি বলেন, এখনো ১০-১৪ শতাংশে আছে ঢাকার শনাক্তের হার, কিন্তু সেটা ২০ শতাংশ বা তার ওপরে উঠে গেলে তখন সব কিছু বন্ধ করেও কোনো লাভ হবে না, তত দিনে সংক্রমণ চূড়ায় উঠে বসবে। তাই এখন থেকে দুই সপ্তাহ যদি যাতায়াত বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে কোরবানি ঈদের সময় গরুর হাট বা ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করা যাবে। তা না হলে ওই সময়ে পরিস্থিতি এমনিতেই চূড়ায় থাকবে। আবার মানুষের গ্রামে যাতায়াত বা গরুর হাট ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে সব মিলিয়ে শনাক্ত ও মৃত্যু অনেক বেশি হবে।
অণুজীববিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার দুটি বিষয় খুব বেশি উদ্বেগের। একটি হচ্ছে—গ্রামেও প্রতিদিন মাঠে-ঘাটে রোদ-বৃষ্টিতে কঠোর পরিশ্রম করা মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে ডেল্টা ভেরিয়েন্টে। আগে যেটা খুবই কম দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকায় নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ যদি গ্রামের মতো ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়, তবে ব্যাপারটি চরম ভয়ের হয়ে দাঁড়াবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কোনো কোনো গবেষণার নমুনায় ৬৫ শতাংশ বা ৮০ শতাংশ ডেল্টা ভেরিয়েন্টে পাওয়া গেলেও আমরা কিন্তু এখনো বেশি পাচ্ছি সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট। তবে আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের চেয়েও ডেল্টা ভেরিয়েন্টের যেহেতু বেশি দ্রুত বিস্তার ঘটে, তাই যদি দুই বা তিন ভেরিয়েন্টের প্রভাব একসঙ্গে চলতে থাকে, তবে কেউ হয়তো অন্য ভেরিয়েন্টে কাবু না হলেও ডেল্টায় কাবু হতে পারে।’
তবে ড. মুশতাক বলেন, এক জায়গায় একসঙ্গে একাধিক ভেরিয়েন্ট খুব একটা থাকে না। নতুন ভেরিয়েন্টের ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটলে তখন তার দাপটে অন্য ভেরিয়েন্ট হটে যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রোগতাত্ত্বিক সপ্তাহ বিবেচনায় ২৩তম সপ্তাহ বা ৬ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত দেশে করোনা শনাক্ত হয়েছিল ১৫ হাজার ১৭২ জন এবং মারা গেছে ২৭০ জন। পরের সপ্তাহে (২৪তম) বা ১৩ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত শনাক্তের হয় ২৩ হাজার ৫৪১ জন ও মারা গেছে ৩৯৫ জন। অর্থাৎ শনাক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৫.১৬ শতাংশ ও মৃত্যু ৪৬.৩০ শতাংশ। সারা দেশের এ পরিস্থিতি হলেও ঢাকায় শনাক্ত বৃদ্ধি বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। ১২ জুন যেখানে শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশে, গতকাল ঢাকায় সেই শনাক্তের হার বেড়ে ১৪ শতাংশে উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদি ডেল্টা ভেরিয়েন্ট যখন সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকেছে, তখন আমরা কঠোরভাবে আটকে দিতে পারতাম তবে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হওয়ার সুযোগ পেত না। কিন্তু আমরা যেমন সীমান্তবর্তী এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারিনি কিংবা সঠিকভাবে কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন করতে পারিনি, ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন ঢাকার ক্ষেত্রেও আমরা যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই তবে সীমান্তবর্তী এলাকার মতোই ঢাকায়ও আনুপাতিক হারেই বিধ্বস্ত হবে। কারণ সামনে কোরবানির ঈদে বড় ঝুঁকি রয়েছে। গতবার গ্রামে বা সীমান্তবর্তী এলাকায় সংক্রমণ ছিল না, ফলে যারা ওই সব এলাকা থেকে গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছিল, তারা অন্ততপক্ষে ভাইরাস নিয়ে আসেনি। কিন্তু এবার যেহতু গ্রামে সংক্রমণ আছে, তাই গ্রামের সংক্রমণ শহরে ছড়ানো সহজ হবে এবং সে ক্ষেত্রে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট আসবে।’ উদাহরণ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ভারতে যদি ৩০ লাখ মানুষের কুম্ভ মেলার কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে, তবে আমাদের সারা দেশে কোরবানির হাটে কয়েক কোটি মানুষের মিলনমেলা ঘটে। ফলে পরিণতি অনুধাবন করা যায়। আবার ঈদে যাতায়াতেও একই পরিণতি ঘটবে। কেউ যদি ভাবে, গত ঈদে ঘটেনি বলে এবারও ঘটবে না সেটা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকার জন্য ডেল্টা ভেরিয়েন্ট মাথায় রেখে আলাদা পরিকল্পনা করে এখনই তা বাস্তবায়ন করা জরুরি।’
এদিকে ঢাকার হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগী। সরকারের ১৫টি হাসপাতালের মধ্যে পাঁচটিতে আবারও আইসিইউ বেডের একটিও খালি নেই। জেনারেল বেডেও রোগী বাড়ছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে। আইসিইউতে জায়গা হচ্ছে না। আমরা এখন এইচডিইউ বাড়ানোর কাজ করছি। এ ছাড়া যদি সংক্রমণ আরো বাড়তে থাকে, তবে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে গতকালও ঢাকা মেডিক্যালের কভিড ইউনিটের ২০টি আইসিইউ বেডের সব, কুর্মিটোলার ১০টি বেডের সব, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালের ১০ বেডের সব রোগীতে ভরা ছিল। এ ছাড়া প্রাইভেট হাসপাতালেও জেনারেল ও কভিড ইউনিটে রোগী বাড়ছে।