পথে-ঘাটে ইলিশ মাছ বিক্রেতাদের হাঁক ছেড়ে ডাকতে শোনা যায়, পদ্মার ইলিশ নেবেন, পদ্মার ইলিশ! বাজারে গেলেও বিক্রেতাদের মুখে শোনা যায় পদ্মার ইলিশ নিয়ে যান, অনেক ভালো। সাধারণ জনতাও পদ্মার ইলিশের সুখ্যাতির কথা বলে থাকেন। কিন্তু গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। পদ্মা নয়, পুষ্টিতে সেরা মেঘনার ইলিশ। মেঘনার ইলিশ বছরের আগস্ট মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত জেলেদের জালে ধরা পড়ে।
ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে দশ বছরের (১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত) তথ্য নিয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করেন একদল গবেষক। এতে দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন। গবেষক দলের সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের অধ্যাপক এস এম শরিফুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গবেষণায় দেখতে পাই, পুষ্টিতে ভরা মেঘনার ইলিশ-ই সেরা।
আলাপকালে গবেষকরা জানান, গত ২০২০ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের নেচার পাবলিশিং গ্রুপের বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্টিফিক রিপোর্টস এ বিষয়ে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। ‘প্রাইমারি প্রোডাক্টিভিটি কানেক্টস হিলশা ফিশারিজ ইন বে অব বেঙ্গল’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ইলিশের পুষ্টিগুণ ও ওজন বৃদ্ধি নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, মূলত সমুদ্রে থাকা অবস্থায় ইলিশের ওজন ও পুষ্টিগুণ কিছুটা কম থাকে। কারণ হিসেবে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেখানে প্রয়োজনীয় খাদ্য উদ্ভিদ ও প্রাণিকণা অনেকটাই কম থাকে। কিন্তু মেঘনা অববাহিকায় এর উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। সাগর থেকে নদীতে আসার সময় ইলিশ স্রোতের উল্টো দিকে ঘণ্টায় ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত সাঁতার কাটে। যাওয়ার পথে শক্তি অর্জনের জন্য খাবারও গ্রহণ করে।
দেশে ইলিশের উৎপাদনের খুবই অল্প অংশ পদ্মা থেকে আসে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। পদ্মার এসব ইলিশ আকৃতিতে ছোট হয়। আর মেঘনা অববাহিকায় বড় ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ইলিশ পাওয়া যায়। গবেষণাপত্রে বঙ্গোপসাগরের ৩৬ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকায় উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণার পরিমাণ বিশ্লেষণ করে বিশদ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, জীববিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী বড় মাছ ছোট মাছকে খায়। কিন্তু ইলিশের খাদ্যতালিকা জুড়ে ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশই উদ্ভিদকণা রয়েছে। মেঘনা অববাহিকায় উদ্ভিদকনা বেশি পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক আনিসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেঘনা অববাহিকায় ইলিশের চলাচল বেশি দেখা যায়। মেঘনা মোহনা এবং সাগরে ইলিশ চলাচল করে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মূলত পদ্মাসহ আশপাশের নদীতে নাব্যতার সংকট থাকার কারণেই ইলিশ মেঘনাকে বেছে নেয়।
গবেষক দলের সদস্য এস এম শরিফুজ্জামানজানান জানান, গবেষণায় মেঘনা অববাহিকায় জাটকা ধরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, দূষণ কমানো এবং বেহুন্দি জাল বন্ধ করার পরামর্শের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে, তার আর্থিক মূল্য দুই বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ লাখ জেলে ওই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ইলিশ মাছের ওপর নির্ভরশীল।
গবেষক দলের অন্যদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এবং বাকি একজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের গবেষক।