বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সমমনা দলগুলোর বাইরে জামায়াত, এনসিপিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছে। এজন্য কেউ জুলাই সনদ স্বাক্ষরের শর্ত দিচ্ছেন, কেউ আবার হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবি তুলছেন। আবার সংস্কারের কথা তুলেও নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছে বলে মনে করে বিএনপি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের কাছে প্রশ্ন ছিল নির্বাচন যথাসময়ে হওয়া নিয়ে বিএনপির কোনো সংশয় আছে কিনা। জবাবে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নির্বাচনী ট্রেনে দেশ উঠে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে গন্তব্যে পৌঁছাবে। এর বিকল্প কিছু ভাবছি না, দেখতেও পারছি না। আশা করি বাকি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবে।’
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় আপাতত স্বস্তি ফিরলেও সামনে পরিস্থিতিতে কোনদিকে যাবে তা এখনই বলা কঠিন। এজন্য সরকারের কঠোরতার অভাব, প্রশাসনের লোকদের সক্রিয়তা না থাকাকে দুষছেন তারা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সামনের পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে সেটা অনিশ্চিত। সরকার ভোটের তারিখ ঘোষণা করতেছে, কিন্তু পুলিশ, প্রশাসনের লোকজন কতটা প্রস্তুত তা কি সরকার জানে? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে। ফলে ঘোষিত সময় নির্বাচন আদৌ হবে কিনা এখনই বলা কঠিন।’
যেভাবে নির্বাচনী ট্রেনে দেশ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয় গতবছরের আগস্টে। শুরুর দিকেই সমাবেশ করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দেয় বিএনপি। ধীরে ধীরে এই দাবি জোরালো করা হয়। অবশ্য একইসময়ে জামায়াতসহ অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কারের আগে নির্বাচনের বিরোধিতা করে।
এরইমধ্যে গত জুনে যুক্তরাজ্য সফরে যান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সফরকালে তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যেখানে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। জবাবে প্রধান উপদেষ্টার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে মত দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়ার কথা জানান। ইতোমধ্যে সেই চিঠি পেয়ে নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি শুরুর কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
এদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবিতে প্রয়োজনে আন্দোলনে নামার কথা বলা হয়েছে। এনসিপিও পিআরের পাশাপাশি জুলাই সনদে স্বাক্ষরের শর্তের কথা বলেছে। চরমোনাই পীরের দলও পিআর পদ্ধতিতে ভোটে জোর দিচ্ছে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা পেয়ে নির্বাচন কমিশন ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে নির্বাচন করার প্রস্তুতিতে মন দিয়েছে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে শিগগিরই। যেখানে ৯ লাখেরও বেশি কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ পাবেন। ১ সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রশিক্ষণ শুরু করার চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান।
অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হতে পারে এমনটা জানিয়েছেন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি জোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে থাকবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
একদিকে চাঙ্গা, অন্যদিকে শঙ্কা বিএনপির
প্রধান উপদেষ্টার গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলায় চাঙ্গা হতে শুরু করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এলাকায় যাচ্ছেন। প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছেন অনেকে।
তবে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আশঙ্কার কথা বলেছেন। শনিবার (০৯ আগস্ট) আলাদা দুটি অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, পতিত আওয়ামী লীগ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের জন্য বাংলাদেশে দাঙ্গা সৃষ্টি হতে পারে। এই দাঙ্গার মাধ্যমে রাজনৈতিক মোড়টা ঘুরিয়ে দিয়ে নির্বাচনটা বানচাল করতে পারে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
আর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ নির্বাচনের আগে দেশে ‘গন্ডগোল’ হওয়ার আশঙ্কা করেছেন। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য অনেক সহিংস ঘটনার অবতারণা করবেন বলেও দাবি করেছেন এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আশা করি সব দল মিলে সুন্দর ভোটের পরিবেশ তৈরি করতে পারলে কোনো কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।’