মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনা শাসনে জান্তার হেফাজতে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) দুজন কর্মকর্তার ‘রহস্যজনক’ মৃত্যু হয়েছে। এক বিশেষ প্রতিবেদনে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির রাজনৈতিক দল এনএলডির এই দুই কর্মকর্তার রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়টি খতিয়ে দেখেছেন বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংবাদদাতা জনাথন হেড।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। তারা সু চির সরকার উৎখাত করে তিনিসহ তাঁর দলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে। পরে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভ মোকাবিলার উপায় নিয়ে তারা শুরুর দিকে দ্বিধায় ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে তারা বলপ্রয়োগের মাত্রা বাড়াতে শুরু করে। মিয়ানমারের জান্তার হাতে এখন পর্যন্ত আট শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।
জান্তার এই শাসনকালে ইয়াঙ্গুনের মধ্যাঞ্চলের পাবেদান এলাকাটি নানা নাটকীয় ঘটনার সাক্ষী। এখানে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিরোধীদের কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পাবেদানের অধিবাসীদের একটি অংশ মুসলমান। গত বছরের সাধারণ নির্বাচনে এখান থেকে এনএলডির মুসলিম প্রার্থী সিথু মং জয়ী হন। তাঁর নির্বাচনী প্রচার ব্যবস্থাপক ছিলেন খিন মং লাট। তিনি অনেক বছর ধরেই এনএলডির সঙ্গে যুক্ত।
মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত
গত ৬ মার্চ রাতে খিন তাঁর বাড়িতেই ছিলেন। রাত ৯টার কিছু পরে তাঁর বাসায় পুলিশ ও সেনারা হানা দেয়। এই সেনারা ৭৭তম লাইট ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের সদস্য ছিলেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য এই ডিভিশনের কুখ্যাতি রয়েছে।
খিনের বন্ধু কো তুন কাইয়ের ভাষ্য, সেনা আসলে এনএলডির জ্যেষ্ঠ নেতা ও আইনজীবী উ সং মাংয়ের খোঁজ করছিলেন। তিনি আগেই লুকিয়ে পড়েছিলেন।
কাই জানান, পুলিশ ও সেনারা খিনের বাড়িতে ঢোকে। তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে আনা হয়। তাঁকে লাথিসহ নানাভাবে আঘাত করা হয়। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। কাইয়ের ধারণা, আটকের পরে খিনকে ইয়াঙ্গুন সিটি হলে নেওয়া হয়। অভ্যুত্থানের পর এই ভবনটি সেনারা নিয়ন্ত্রণে নেয়।
পরদিন সকালে খিনের পরিবার পুলিশের কাছ থেকে একটি ফোন পায়। পরিবারকে বলা হয়, তারা যাতে ইয়াঙ্গুনের উত্তরাঞ্চলের একটি সামরিক হাসপাতালে এসে খিনের লাশ নিয়ে যায়। হাসপাতালে পরিবারকে বলা হয়, খিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে অন্যদের জানাতে বলা হয়।
পরিবার জানায়, ৫৮ বছর বয়সী খিন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁর কোনো রোগ ছিল না বলেই তাঁরা জানেন। পরিবারের সদস্যরা খিনের শরীরে আঘাতের একাধিক চিহ্ন দেখতে পান। তাঁর লাশ রক্তভেজা একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। খিনের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। কিন্তু পরিবারকে তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কিত কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি। পরে তাঁকে দাফন করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস খিনের মৃত্যু সম্পর্কিত সব আলামত ও তথ্যপ্রমাণ যাচাই করেছে। তারা সুনির্দিষ্ট করে তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তবে তারা বলেছে, সেনা কর্তৃপক্ষ খিনের মৃত্যুর যে কারণের কথা বলেছে, তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। হেফাজতে থাকাকালে তিনি সম্ভবত নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন।
কাইয়ের বিশ্বাস, খিনকে ইচ্ছাকৃতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে হয়তো এনএলডির পরিকল্পনা বা দলটির নেতারা কোথায় লুকিয়ে আছেন, সে সম্পর্কিত তথ্য আদায় করার চেষ্টা করা হয়েছিল। খিন এনএলডির মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। সম্ভবত এই কারণেই তিনি জান্তার নিশানায় পরিণত হয়েছিলেন।
আরেক নৃশংস মৃত্যু
খিনের মৃত্যুর দুদিন পর এনএলডির আরেক কর্মকর্তা জ মিয়াত লিনের মৃত্যু হয়। সামরিক জান্তা যে সু চির দলকে নিশানা করে অভিযান চালাচ্ছে, এই ঘটনা সেই তত্ত্বকে আরও জোরদার করে। খিনের চেয়েও জনপ্রিয় ছিলেন জ। তাঁকে আরও বেশি নৃশংসে উপায়ে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
৪৬ বছর বয়সী জ ইয়াঙ্গুনের শিল্প জেলা শুয়ে পাই থারের একটি কারিগরি কলেজের পরিচালক ছিলেন। তিনি এনএলডির একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানের পর গ্রেপ্তার এড়াতে পারা রাজনৈতিকদের নিয়ে গঠিত সিআরপিএইচ নামের কমিটির স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সিআরপিএইচ মূলত এনএলডির আইনপ্রণেতাদের নিয়ে গঠিত।
গ্রেপ্তারের আগের দিন জ ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। তিনি লোকজনকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিপ্লবী লড়াই অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। লুকিয়ে থাকা এনএলডির এক কর্মকর্তা জানান, জ খুব ভালো বক্তা ছিলেন। তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারতেন। তিনি সেনাবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করতে পারতেন।
আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ৮ মার্চ সন্ধ্যায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে কলেজে ফেরেন জ। দিবাগত রাত ২টার কিছু আগে সেনারা ফটক ভেঙে কলেজে প্রবেশ করে। ছাত্ররা তাঁদের শিক্ষককে পেছনের দেয়াল টপকে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেনারা সাত ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তখন জ-এর অবস্থা কেউ জানতে পারেনি।
পরদিন বেলা ৩টার দিকে জ-এর স্ত্রী ফিউ ফিউ উইন স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোন পান। তাঁকে জানানো হয় যে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। তিনি তাঁর স্বামীর লাশ দেখতে পারেন। ইয়াঙ্গুনের উত্তরাঞ্চলের একটি সামরিক হাসপাতালে তাঁর লাশ রাখা ছিল। পরিবার জ-এর লাশটিকে খুব খারাপ অবস্থায় পায়। তাঁর পেটের অনেকটা অংশজুড়ে কাটা ছিল। জ-এর শরীরের অন্য অংশেও আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান তাঁর স্ত্রী।
পরে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, পালিয়ে যাওয়ার সময় লোহার পাইপের ওপর পড়ে মারা গেছেন জ। তাঁর মৃত্যু নিয়ে কেউ ভিন্ন কথা বললে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের চিকিৎসকেরা জ-এর লাশের ছবি পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা এই বলে উপসংহার টেনেছেন যে জ-এর মৃত্যু নিয়ে সেনা কর্তৃপক্ষের ভাষ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এনএলডির এই দুই কর্মকর্তা কেন এমন নৃশংসতার শিকার হলেন, তা জানা যায়নি। তবে সব তথ্য-প্রমাণ ও আলামতে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে।