কিছু বিষয়ে সমালোচনা করলেও বাংলাদেশে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে বিরোধিতা করে কমিশন বাতিলের দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম।
নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন শনিবার (১৯ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জানিয়েছে, এর পরপরই মন্ত্রণলায় ও বিভাগকে সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেন অধ্যাপক ইউনূস।
নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা স্বাগত জানানোর পাশাপাশি প্রস্তাবের কিছু বিষয়ের সমালোচনা করেছেন। সুপারিশে কিছু অস্পষ্টতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। সেই সঙ্গে লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর অধিকারের বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলাম সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে বিরোধিতা করেছে। শুধু বিরোধিতা নয় কমিশন বাতিলের দাবিও জানিয়েছে তারা।
প্রস্তাবে যা আছে
নারী বিষয়ক কমিশন মোট ৪৩৩টি প্রস্তাব বা সুপারিশ দিয়েছে। অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে সেই আসন থেকে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়েছে।
নারী বিষয়ক কমিশন প্রতিষ্ঠা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, ধর্ষণের শিকার হওয়া অন্য লিঙ্গের মানুষের বিচার ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিতে আইনে ধর্ষণ ধারায় সংস্কার আনা, যেকোনো উপস্থাপনায় অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা, নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও যথাযথ সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচি নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।
পাশাপাশি নারীর মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা, যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদের (সিডো) দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮৯ ও ১৯০ অনুচ্ছেদ অনুস্বাক্ষর করার সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
একইসঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি দেওয়া এবং পূর্ণ বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের মতো সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে।
কমিশনের প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের প্রতিটি শাখা ও স্তরে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ অনুসরণ করে সব ধরনের গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক উপস্থাপন বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। গণমাধ্যমে অংশগ্রহণের জন্য নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে ব্যবহার না করা, অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নারীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন, নারী ও মেয়েশিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ, জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর অগ্রগতির জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বাড়ানো, সব বয়সি নারীর জন্য সুস্বাস্থ্য, শ্রমে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার, নারী শ্রমিকের নিরাপদ অভিবাসন, দারিদ্র্য হ্রাসে টেকসই সামাজিক সুরক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশ, দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা নারীদের জীবন ও সম্পদ রক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে।
ইতিবাচকতা ও সমালোচনা
সুপারিশগুলোকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, এপর্যন্ত সংবাদমাধ্যম থেকে কমিশনের সুপারিশের ব্যাপারে যা জেনেছি তাতে আমার প্রস্তাবগুলো ইতিবাচকই মনে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এগুলো কবে বাস্তবায়ন কবে কীভাবে হবে?
তিনি আরও বলেন, সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, এগুলো আমাদের দাবি ছিল। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনসহ আসন ৬০০ করার প্রস্তাব ভালো। তবে এরইমধ্যে কোনো কোনো গোষ্ঠীর বিরোধিতা শুরু করেছে। আমার কথা হলো কোনো ধর্মের ভিত্তিতে নয়, রাষ্ট্রের নাগরিক ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে নারীর জন্য আইন ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তার মতে, যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসবে স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আছে। কোনো অসম্মানজনক পেশা বা জোর করে যে পেশায় বাধ্য করা হয় সেটা পেশা কিনা আগে ভাবতে হবে। তবে নারীর জন্য কোটা রাখতেই হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সমালোচনা করে বলেন ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, যৌনকর্মী যেন নারীরাই হয় এই ধরনের চিন্তার প্রতিফলন আমি দেখতে পেয়েছি এই প্রতিবেদনে। এটা নারী-পুরুষ বা অন্য লিঙ্গের হতে পারে। ফলে এখানে দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা আছে।
নারীদের জন্য নির্দিষ্ট আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি। আসন কীভাবে বন্টন করা হবে, শ্রমিক নারী কতজন হবে, বেদে বা হিজড়াদের কতটি আসন থাকবে এমন সব বিষয় অস্পষ্ট রয়ে গেছে বলে মত তার।
ড. রেজওয়ানা আরও বলেন, তালাক আর সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে যা বলা হয়েছে তা আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু অবিবাহিত নারী শিশু দত্তক নিতে পারবে কিনা তা পরিস্কার করা হয়নি। লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর যারা আছেন তাদের অধিকারের বিষয়গুলো একদমই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এখনও শব্দ চয়নে জেন্ডার বৈষম্য আছে। তা দূর করার প্রস্তাব নেই। রাষ্ট্রপতি শব্দ বহাল আছে। ধর্ষণের শিকার না বলে ধর্ষিতা বলা হচ্ছে। আর যৌনকর্মী বলতে শুধু নারীদেরই বোঝানো হয়েছে। যেকোনো লিঙ্গের মানুষই যৌনকর্মী হতে পারেন। আবার সম্পত্তির সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধি নারী ও শিশুর জন্য কী বিধানের কথা বলা হয়েছে? আমার চোখে পড়েনি।
বিতর্কের বিষয়
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, আমি যতটুকু জেনেছি তাতে এখন পর্যন্ত সুপারিশগুলো আমার কাছে ইতিবাচকই মনে হয়েছে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের আগেই হেফাজতে ইসলাম এর বিরোধিতা শুরু করেছে। তারা কমিশনই বাতিল চেয়েছে। তাহলে সরকার তাদের কীভাবে সামলাবে সেটা তারা দেখবে।
তিনি বলেন, ইসলামের কথা বলে তারা সম্পত্তিতে নারীদের সামান অধিকারের বিরোধিতা করছে। কিন্তু দেশে আইন আছে যে পিতা-মাতার ভরণপোষনের দায়িত্ব ছেলে-মেয়ের উভয়ের সমান। তার বিরোধিতা তারা করছে না। আবার তারা যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধিতা করছে, কিন্তু যে পুরুষ যৌনকর্মীদের কাছে যায় তাদের ব্যাপারে কিছু বলছে না। তারা যেখানে ধর্ম ব্যবহার করায় সুবিধা সেখানে ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, কমিশন মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করেছে। ইসলামই নারী পুরুষের সম্পত্তির অধিকারে বিধান করে দিয়েছে। ইসলাম নারীর অধিকার দিয়েছে। সমান অধিকার কোনো ন্যায্য কথা নয়। ন্যায্য কথা হলো যার যা অধিকার তা সে পাবে। আর তারা ২০১২ সালের নারী নীতিমালা পুনর্বাহলের সুপারিশ করেছে। আমরা ওই নারী নীতিমালা আগেই প্রত্যাখ্যান করেছি। আর যৌনকর্মীদের যে শ্রমিকের অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোরান ও সুন্নাহ বিরোধী।
তিনি বলেন, আমরা সংবাদ সম্মেলন করে এই কমিশন বাতিল চেয়েছি। ৩ মে আমাদের মহাসমাবেশ আছে। তার আগে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে এ নিয়ে আরও বিস্তারিত আমাদের অবস্থান জানাবো।