চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ঘুষ গ্রহণ, অপরাধমূলক অসদাচরণ এবং বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নিজ বা পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠায় সেগুলো অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দুদকের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ও উপ-সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুনের সমন্বয়ে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে।
অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র তলব করা হয়েছে। বেশকিছু নথিপত্র আসতেও শুরু করেছে।
এ বিষয়ে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিটি অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে অনুসন্ধান টিম গঠিত হয়েছে। তারা কাজও শুরু করে দিয়েছে। অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে পতিত শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান আনিসুল হক। তার সময় থেকে ধীরে ধীরে কলুষিত হতে থাকে বিচার বিভাগ। আইন মন্ত্রণালয়, ঢাকা এবং এর আশপাশের আদালতে কর্মরত বেশকিছু বিচারক মন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) বিকাশ কুমার সাহা, ঢাকার সাবেক মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) রেজাউল করিম ও সাবেক অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম (এসিএমএম) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর। ঘুষ গ্রহণ, অপরাধমূলক অসদাচরণ ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে তারা নিজ বা পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন।
ইতোমধ্যে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঘুষ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িত বিচারকদের খুঁজতে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে আইন মন্ত্রণালয়। ওই কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ মার্চ ওই তিনজনকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় দুদক থেকে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আনিসুল হক আইনমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়মের মাধ্যমে সারা দেশের আদালতগুলোতে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। শুধু আদালতেই নয়, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও বড় ধরনের ‘নিয়োগ-বাণিজ্য’ করেন সাবেক আইনমন্ত্রী। নিয়োগ-বাণিজ্যের পাশাপাশি বদলি ও মামলা নিয়ে বাণিজ্যেরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এসব অনিয়মের মাধ্যমে তিনি শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন।
বিকাশ কুমার সাহার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
আইন ও বিচার বিভাগের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বিকাশ কুমার সাহা যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-১) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে কক্সবাজার জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালত ও জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থায় কর্মচারীদের শূন্য পদে আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন। যার বিনিময়ে ঘুষ হিসেবে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে ওই চাকরিপ্রার্থীদের কোনো চাকরি প্রদান না করে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন এবং টাকা প্রদানকারীরা ওই টাকা ফেরত চাইলে তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ বলছে, বিকাশ কুমার সাহা এক সময়ে ঢাকার সিএমএম কোর্টে বদলি, জামিন ও খালাস বাণিজ্য করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ছেলেকে স্থায়ীভাবে পাঠিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সিংহভাগ অর্থ পাচার করেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। তার নামে ঢাকার গুলশানে ১৭০০ বর্গফুটের আলিশান ফ্ল্যাট রয়েছে।
বিচারক রেজাউল করিম ও আসাদুজ্জামান নূরের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, বর্তমানে কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক (জেলা জজ) রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। তিনি ডিবি হেফাজতে থাকা মামলায় জব্দকৃত আলামত একটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িসহ অন্য আরেকটি গাড়ি নিজ হেফাজতে নিয়ে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন।
এছাড়া অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় সাত কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন তিনি। আশিয়ান গ্রুপের একটি মামলায় বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে পাঁচ কাঠার প্লট নেন। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দ্বারা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে তিনতলা একটি বাড়ি নির্মাণ করেন এবং চট্টগ্রামের জাকির হোসেন রোডের ইয়াকুব সেন্টারে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। সিএমএম পদের অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একাধিকবার পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বিল পরিশোধ না করারও অভিযোগ আছে রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে অপরাধমূলক অসদাচরণের অংশ হিসেবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আদালতে সাক্ষ্য দিতে গেলে ঢাকার তৎকালীন সিএমএম রেজাউল করিম ও এসিএমএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর তাকে বেআইনিভাবে অভ্যর্থনা জানান। তাদের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষীকে গাড়ি থেকে এগিয়ে আনা এবং গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া সংক্রান্ত অভিযোগও আনা হয়েছে।
ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, সাক্ষী সজীব ওয়াজেদ জয় আদালত এলাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার তৎকালীন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরী ও ঢাকার তৎকালীন অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর তাকে এগিয়ে আনতে খাসকামরা থেকে বের হয়ে জয়ের গাড়ির কাছে যান এবং তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসেন। সাক্ষ্য প্রদান শেষে যাওয়ার সময়ও তাকে অনুরূপভাবে তারা গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসেন।