বরিশালের গৌরনদী উপজেলায় কলেজছাত্রী নাজনীন আক্তার হত্যায় তার স্বামী ছাড়াও শ্বশুর-শ্বাশুড়ি জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা পুলিশের। পৃথক স্থানে নিহত ওই কলেজছাত্রীর শরীরের অংশ পাওয়ায় এমনটাই সন্দেহ করা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, ঘাতক সাকিব হাওলাদারের স্বীকারোক্তি মতে নাজনীনকে হত্যার পর মরদেহ বাড়ির পেছনের সেপটিক ট্যাংকিতে ফেলা হয়। অভিযানে সেই ট্যাংকির ভেতর থেকে নাজনীনের শরীরের চামড়া, নখ ও ওড়না উদ্ধার হয়। এর বেশি কোনো তথ্য জানাতে পারেনি সাকিব। তবে পরের দিন নাজনীনের মরদেহ পাওয়া যায় ওই বাড়ির অদূরে ধানক্ষেতে। সেফটিক ট্যাংক থেকে ধানক্ষেতে মরদেহ কীভাবে গেল সেই প্রশ্নের সমাধান না হলে এই হত্যা মামলা ধোঁয়াশাই থেকে যাবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বগুড়া সদর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম মোস্তফা জানান, যে কারণেই হোক নাজনীনকে হত্যা করেছে তার স্বামী সাকিব; যা তিনি সবার সামনেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু খুনের পর তিনি মরদেহ সেপটিক ট্যাংকে ফেললেও পরে সেই মরদেহ বস্তাবন্দি অবস্থায় ধানক্ষেতে পাওয়া গেছে। তার একার পক্ষে অতদূর মরদেহ নেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভবত ছেলেকে বাঁচাতে মা-বাবাসহ আরও কয়েকজন মিলে মরদেহ গুম করতে পারেন।
গোলাম মোস্তফা বলেন, সাকিব পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে হত্যার ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে এবং ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেলে পরের রাতে পরিবারের সবাই মিলে সেপটিক ট্যাংক থেকে মরদেহ তুলে ধানক্ষেতে ফেলে দিয়েছেন। তবে এখনি চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। মামলা তদন্তাধীন। তদন্ত শেষে পুরো তথ্য জানানো হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৩ জুন) দুপুরে নিহত নাজনীনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সম্পন্ন হয়। দুপুর ২টার দিকে মর্গ থেকে মরদেহ গ্রহণ করেন নাজনীনের বড় ভাই আব্দুল আহাদ প্রমানিক। তিনি জানিয়েছেন, মরদেহ বগুড়ায় নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে জানাজা শেষে শুক্রবার দাফন করা হবে।
গৌরনদী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফজাল হোসেন বলেন, মঙ্গলবার (১ জুন) ঘাতক সাকিবের দেখানো স্থান সেপটিক ট্যাংকে নিহতের নখ, চামড়া ও ওড়না পাওয়া যায়। পরে বুধবার (২ জুন) সকালে স্থানীয় ট্রাক্টরচালক দুখু হাওলাদার হরহর গ্রামের বিলের মধ্যে জমি চাষ করতে গিয়ে বস্তাবন্দি মরদেহ দেখতে পেয়ে থানায় খবর দেন। পরবর্তীতে বগুড়া থেকে নাজনীনের স্বজনরা এসে মরদেহ শনাক্ত করেন। বৃহস্পতিবার ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ নিহতের ভাইয়ের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিহত কলেজছাত্রী নাজনীন আক্তার বগুড়া সদর থানার সাপগ্রামের আব্দুল লতিফের মেয়ে ও স্থানীয় সৈয়দ আহম্মেদ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ফেসবুকের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার নতুনচর জাহাপুর গ্রামের আব্দুল করিম হাওলাদারের ছেলে সাকিব হোসেন হাওলাদারের। সাকিব হোসেন বগুড়ার জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাসে ঝাড়ুদার হিসেবে কর্মরত।
ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাকিব ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে কলেজছাত্রী নাজনীনকে বিয়ে করেন। গত ২৪ মে সাকিব তার বাবা অসুস্থ বলে নাজনীনকে নিয়ে বরিশালে যান।
সাকিব বলেন, রাত ৯টার দিকে গৌরনদীর বাটাজোর ইউনিয়নের হরহর গ্রামে বাবার ভাড়াটিয়া সালাউদ্দিনের বাড়িতে আমরা আসি। এ সময় আমার বাবা-মা কেউ বাসায় ছিলেন না। নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমার স্ত্রী নাজনীন আমাদের কাঁচাঘর ও টয়লেট দেখে আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে। টয়লেটে টিনের বেড়া দেখে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এতে আমি ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরের বাইরে থাকা প্লাস্টিকের রশি দিয়ে তাকে গলায় ফাঁস ও বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করি। পরে পাশের সেপটিক ট্যাংকে মরদেহ গুম করি। আমার শ্বশুর আব্দুল লতিফ প্রমাণিক ২৬ মে আমার ইউনিটে ও থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউনিট ইনচার্জ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি খুন ও মরদেহ গুমের কথা স্বীকার করি।
এদিকে সাকিবের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তাকে নিয়ে মঙ্গলবার (১ জুন) গৌরনদী মডেল থানা পুলিশের সহায়তা বগুড়া সদর থানা পুলিশ তাদের বাড়ির সেপটিক ট্যাংকে পাম্প দিয়ে পানি নিষ্কাশন করে। ট্যাংকের মধ্যে মরদেহের বিভিন্ন অংশ, চামড়া, দুটি নখ এবং নাজনীনের পরিধেয় ওড়না পাওয়া যায়। মরদেহ পাওয়া না যাওয়ায় আসামিকে নিয়ে বগুড়া ফিরে যায় পুলিশ। এর পরদিন বুধবার (২ জুন) গৌরনদীর হরহর গ্রামের একটি ধানক্ষেতে নাজনীনের মরদেহ পায় পুলিশ।