বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা করে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে৷ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনকে (আরসিবিসি)৷ ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (নিউইয়র্ক ফেড) থাকা বাংলাদেশের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে৷
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, শেখ হাসিনার শাসনামলের গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে৷
অন্যদিকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ২০২৪ সালে এক গবেষণায় ৫০ বছরে বাংলাদেশে থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা বলে জানায়৷ আর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্ট্রিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯ হাজার কোটি বা ৯০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে৷
বর্তমান সরকার পাচার হওয়া অর্থের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে খুবই তৎপর৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বার বার বলেছেন বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়েছে তা বিশ্বে নজিরবিহীন এবং একটি রেকর্ড৷
পাচারের অর্থ ফেরত আনতে এরইমধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে৷ আর পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠান নিযুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতিনিধি ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের প্রক্রিয়া চলছে৷ আর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাচ্ছেন৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান বলেন, ‘আমরা পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে নানা উদ্যোগ নিচ্ছি৷ কিন্তু ৫ আগস্টের পর কোনো টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়নি৷ এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া৷ তবে রিজার্ভ হ্যাক করে যে টাকা নেওয়া হয়েছিল তার ৪০ ভাগের মতো এ পর্যন্ত ফেরত এসেছে৷ আমরা তো আগেই এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা করেছি৷ রিজার্ভের অর্থ বিভিন্ন সময়ে ফেরত এসেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অর্থ পাচারের ব্যাপারে তদন্ত করে দুদক৷ আর আমরা গোয়েন্দা তথ্য যোগাড় করি৷ আমরা স্থানীয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করি৷ সেই তথ্য আমরা যেসব দেশে প্রয়োজন সেসব দেশকে দেই৷ তারাও আমাদের তথ্য দেয়৷ এভাবে আমরা পাচার হওয়া অর্থের তথ্য সংগ্রহ করি।’
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে অন্তর্বর্তী সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে৷ এই টাস্কফোর্সের উদ্দেশ্য হলো-
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিতকরা ও তদন্তে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সহযোগিতা করা৷
পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে করা মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা ও তা দূরীকরণে উদ্যোগ নেওয়া৷ বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া৷ জব্দ বা উদ্ধার হওয়া সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া৷
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশি, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ, তথ্য আহরণ করা৷ পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সক্ষমতা বাড়ানো ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন৷
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই টাস্কফোর্সের সদস্য৷ দুদক বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত ১২টি দেশে ৭১টি চিঠি ও মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে৷ এরমধ্যে ২৭টি এমএলএআরের জবাব পেয়েছে সংস্থাটি৷ দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন এই তথ্য জানিয়েছেন৷
দুদক মহাপরিচালক বলেন, ‘‘মানি লন্ডারিং, পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফেরত পেতে পারি তা নিয়ে আমরা অর্থ পাচার হওয়া দেশগুলোর নাম তাদের কাছে তুলে ধরেছি৷ বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে মানি লন্ডারিং বেশি হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম বলেন, ‘আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হলো পাচার হওয়া টাকা চিহ্নিত করা৷ আর সেটা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার হলেই তারা চিহ্নিত করতে পারে৷ কোনো ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন দেখলে তারা সেটা তদন্ত করে৷ তারা সেটা প্রমাণ পেলে দুদক আইনগত ব্যবস্থা নেয়৷ এরপর মামলা ও তদন্ত হয়৷ বিচারে প্রমাণ হলে দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সেই দেশের চাহিদামতো কাগজপত্র দিলে তারা অর্থ ফেরতের বিষয়টি বিবেচনা করে৷ তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারই সিঙ্গাপুর থেকে অর্থ ফেরত আনা গেছে।’
সিঙ্গাপুরের আদালতের নির্দেশে ২০১২ ও ২০১৩ সালে ফেয়ারহিল নামে একটি পরামর্শক সংস্থার নামে ব্যাংকে গচ্ছিত থাকা প্রায় এক মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের আদালতের নির্দেশনার পরও মামলাটি নিষ্পত্তি হতে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর৷
আবুল কাসেম বলেন, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অর্থ পাচার বিরোধী জোট এগমন্ড গ্রুপের সদস্য৷ এরফলে সদস্য দেশলোর সঙ্গে অর্থ পাচারের তথ্য আদান প্রদান করতে পারে৷ তবে সেখানে শর্ত থাকে যে ওই তথ্য আদালতে উপস্থাপন করা যাবে কি না৷ উপস্থাপন করতে হলে তাও আগে থেকে চুক্তি করে নিতে হয়।’
আর যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নুরুল আমিন বলেন, ‘বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৮৭টি দেশ এগমন্ড গ্রুপের সদস্য৷ এর বাইরে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্টের মাধ্যমে পাচারের অর্থ ফেরত আনা যায়৷ কিন্তু সেটা তো প্রমাণ সাপেক্ষ৷ আবার অনেক দেশ আছে যে তারা আপনাকে তথ্য দেবে না, তাদের আইনের কারণে৷ ফলে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা অসম্ভব না হলেও কঠিন৷ তার চেয়ে ভালো হলো, পাচার রোধে ব্যবস্থা নেওয়া৷ বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও আরও সংস্থা আছে যারা অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করে৷ তারা সক্রিয় হলে পাচার কমে যাবে।’
তার কথা, ‘পাচার ব্যাংকিং চ্যানেলে হয়, আমদানি-রফতানির নামে হয়, হুন্ডির মাধ্যমে হয়, সরাসরি হয়৷ পাচারের ল্যান্ডিং এবং ডেস্টিনেশন প্রমাণ করতে হয়৷ এখন বাংলাদেশের টাকা দুবাই থেকে যদি আরেক দেশে পাচার হয় তাহলে ধরা কঠিন৷ আবার ঢাকায় বাড়ি বিক্রি হয়, পেমেন্ট হয় সিঙ্গাপুরে। তাহলে তো পাচার ধরা কঠিন।’
বাংলাদেশে অর্থ পাচারের অপরাধগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), পরিবেশ অধিদফতর, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)৷ আর সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব বিএফআইইউর৷ সূত্র: ডয়েচে ভেলে।