রোববার অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটি যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তাতে এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে পাচার হয়েছে ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই রিপোর্ট জমা দিয়ে কমিটি জানিয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও আর্থিক কারচুপির যে তথ্য পাওয়া গেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। এ সময় কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করে রিপোর্ট প্রদান করেছে।
পরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর যে অর্থনীতিকে যে ভঙ্গুর অবস্থা আমরা পেয়েছি তা এই রিপোর্টে উঠে এসেছে।’
সোমবার এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ২৮ আগস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়।
কমিটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’।
বিদেশে অর্থ পাচার হয়েছে কত?
হাসিনা ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায়ই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে দেশ থেকে অর্থপাচার হওয়ার বিষয়টি নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থাও বিভিন্ন সময় অর্থপাচার নিয়ে নানা ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, সিআইডি ও দুদকের সহায়তায় বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে কাজ শুরুও করে। তিন মাসের তদন্ত শেষে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি রোববার রিপোর্ট প্রদান করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
এতে দেখা যায় গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন বা এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। টাকার অংকে যা প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা।
অর্থপাচারে জড়িতদের বিচারের জন্য একটি বিশেষ প্রসিকিউশন শুরু করা উচিত বলে মনে করেন কমিটির সদস্য ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
পরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমাদের গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে তারা লুণ্ঠন করেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। দুঃখের বিষয় হলো, তারা প্রকাশ্যে এই লুটপাট চালিয়েছে। আমাদের বেশিরভাগ অংশই এর মোকাবিলা করার সাহস করতে পারেনি’।
প্রকল্পে লুটপাট, দুর্নীতি-অনিয়ম
বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ছোট বড় মিলিয়ে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এসব প্রকল্প নিয়ে কাজ করে।
এর মধ্যে বড় ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
এতে কমিটি দেখেছে বড় প্রকল্পের প্রতিটিতে দশ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা সাত লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা।
কমিটি প্রধান উপদেষ্টাকে জানায়, এসব প্রকল্পে জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং জমি কেনায় হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে বাড়ানো হয়েছে অনেক। যা টাকার অঙ্কে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা।
কমিটি জানিয়েছে কোথাও কোথাও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত।
কমিটির সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক এসময় জানান, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপিতে সাত লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে।
এসময় প্রধান উপদেষ্টা এসময় বলেন, ‘পতিত স্বৈরাচারী শাসনামলে ভয়ের রাজত্ব এতটাই ছিল যে বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণকারী বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোও এই লুণ্ঠনের ঘটনায় অনেকাংশে নীরব ছিল।’
বিদ্যুৎ খাত ও অন্যান্য
প্রস্তাবিত শ্বেতপত্রে ছয়টি বিষয়ে আলোকপাত করার প্রস্তাব রেখেছিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
সেগুলো হলো- সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা, বাহ্যিক ভারসাম্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান।
রোববার এই শ্বেতপত্র প্রদান অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এই রিপোর্টে বিগত সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অনিয়ম দুর্নীতির তথ্যও উঠে এসেছে।
কমিটির আরেক সদস্য এম তামিম বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিগত সরকারের আমলে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে যদি দশ শতাংশও অবৈধ লেনদেন ধরা হয়, তাহলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার।’
এ সময় কর অব্যাহতি, আর্থিক অব্যবস্থাপনাসহ আর্থিক অসঙ্গতির নানা চিত্রও উঠে আসে রিপোর্টে। কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ছয় শতাংশ। এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেত’।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এই শ্বেতপত্র প্রণয়নের বিষয়টিকে যুগান্তকারী কাজ দাবি করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আগামীতে এটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো উচিত’।