বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি (২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি) গ্রহণ করতে হয়, তাতে প্রতি মাসে ব্যয় হওয়ার কথা ১ হাজার ৮০০ টাকা। সরকারিভাবে এটিকেই ফুড পোভার্টি লাইন বা খাদ্য দারিদ্র্যসীমা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক হিসাব অনুযায়ী, জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু ব্যয় করতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫১ টাকা। সে অনুযায়ী, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার গ্রহণে একজন মানুষের ব্যয় হচ্ছে খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
টানা ছয় মাস ধরে ১০ শতাংশের ওপরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার। সর্বশেষ গত মাসেও তা ছিল ১২ শতাংশের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রচুর মানুষ আছে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে বসবাস করলেও অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। অর্থনৈতিক সামান্য ধাক্কা বা অভিঘাতেই তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসার জোর আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের আনুমানিক হিসাবে এর পরিমাণ অন্তত দুই কোটি। বর্তমান পরিস্থিতিতেও এরাই সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন। চিকিৎসা ও পড়াশোনার ব্যয় কমিয়ে তা দিয়ে পুষ্টি ব্যয় নির্বাহের চেষ্টাও করছেন অনেকে। এ পরিস্থিতিতে এখন রোগ-বালাই ও অশিক্ষা বেড়ে গিয়ে সামগ্রিকভাবে সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদন সক্ষমতাও কমে আসার জোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিবিএসের হিসাবে, একজন মানুষের দৈনিক ন্যূনতম ২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের সেট বা ফুড বাস্কেট গঠন হয় মৌলিক ১১টি খাদ্যের পরিমিত হিসাব বিবেচনায় নিয়ে। এ ১১ খাদ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, গম, ডাল, দুধ, ভোজ্যতেল, মাছ, মাংস, আলু, অন্যান্য সবজি, চিনি ও ফল। খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম ক্যালরি অনুপাতে দৈনিক নির্ধারিত পরিমাণে এসব খাবার খেতে হলে একজন মানুষকে কমপক্ষে ১ হাজার ৮০০ টাকা খরচ করতে হবে। এর কম ব্যয়ে একজন মানুষের পক্ষে প্রয়োজনীয় পুষ্টির সংস্থান করা অসম্ভব।
বর্তমান লাগামহীন মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে বিবিএস সংজ্ঞায়িত এ খাদ্য দারিদ্র্যসীমা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকছে না। পুষ্টিবিদরা বলছেন, ব্যয় বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। ফলে তারা কম কিনছেন, কম খাচ্ছেন। এতে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো আকতারুজ্জামান বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বাড়লেও মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। ফলে মানুষ কম কিনে কম খেতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের কষ্ট হচ্ছে। ভাত হয়তো খাচ্ছে তবে মাছ-মাংস, ফলমূল-দুধ কম খাচ্ছে, যার স্বাস্থ্যগত প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে শিশু-কিশোরদের মধ্যে।’
ডব্লিউএফপির তথ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম ক্যালরি গ্রহণের জন্য নির্ধারিত ফুড বাস্কেটের প্রতিটি উপাদানের মূল্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে; এজন্য মাথাপিছু প্রতি মাসে ৩ হাজার ৫১ টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর পেছনে সাম্প্রতিক সময়ে চালের ১৯ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া মুরগি, ডিম, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও সব ধরনের সবজির মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণের ব্যয়কে উস্কে দিয়েছে।
পুষ্টি ব্যয় বাড়ায় দেশে অপুষ্টি ও রোগব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো কম খাবার গ্রহণের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পুষ্টিহীনতা বেড়ে যায়। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও কমে যায় রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। ফলে নানাবিধ রোগ-ব্যাধির প্রকোপও বাড়ে এবং জাতীয় উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুর বলেন, ‘পুষ্টিহীনতার ফলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়। শিশুদের ওজন কমে যায় এবং তারা খর্বাকার হয়ে পড়ে। গর্ভবতী নারীরাও সুস্থ শিশু জন্মদানের ক্ষমতা হারায়। হৃদরোগের প্রকোপ বাড়ে। ফলে সামগ্রিকভাবে একটি স্বাস্থ্যহীন জাতি তৈরি হয়, যা উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে দেয়। আবার চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গিয়েও অর্থনৈতিক চাপ বাড়ে।’
শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার তুলনামূলক বেশি বলে বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। মূল্যস্ফীতির চাপ ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংকট তাদের ওপরেই সবচেয়ে মারাত্মক আকারে জেঁকে বসেছে। আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরতদের হারের চেয়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুক্তভোগীর হার বেশি। অর্থাৎ দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থানরতরাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ভুগছে।
জাতিসংঘের এ খাদ্য সংস্থাটির সাম্প্রতিক আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। আর প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। খাদ্যে ব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা দুই কোটি মানুষ নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে অনেকে চিকিৎসা ও পড়াশোনার ব্যয় কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা দুই কোটি মানুষও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। দ্রুত বাজার পরিস্থিতি ও বিনিয়োগ চাঙ্গা করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে মাত্র তিন মাসের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও মানুষের প্রত্যাশা আরো বেশি।’