এদিকে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার সবুজ শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন সম্মেলনে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী নেতা, ব্যাংক ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা।
অন্যদিকে সম্মেলনের সাইডলাইনে এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের কার্বন মার্কেট, ক্লাইমেট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিক্সের গ্লোবাল লিডার চন্দ্র শেখর সিনহা এক আলোচনায় বলেন, কার্বন বাজার থেকে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন আয়ের সম্ভাবনাময় বাজার রয়েছে বাংলাদেশের।
শনিবার (১৬ নভেম্বর) ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (আইডিসিওএল) কপ-২৯-এর বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে “বাংলাদেশ জার্নি ইন আর্টিকেল ৬: পাইওনিয়ারিং কার্বন মার্কেট অপর্চুনিটিস” শীর্ষক আলোচনায় এই সম্ভাবনার ইস্যুটি আলোচকদের বক্তৃতায় উঠে আসে।
আলোচনায় ইডকলের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগের প্রধান মো. এনামুল করিম পাভেল বলেন, বাংলাদেশে ১:০ থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের কার্বন ব্যবসার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরেক কার্বন ট্রেডিং বিশেষজ্ঞ শ্যামল বর্মন তার প্রতিধ্বনি করেছেন এবং বলেছেন প্রতি টন বাজার মূল্য ২০ থেকে ৩০ ডলারে উন্নীত হতে পারে। তিনি বলেন, ২০৩০ সালের নাগাদ বছরে বাংলাদেশের চার কোটি টন কার্বন বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে এটা বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তার প্রয়োজন আছে।
পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. হারুন অর রশীদ বলেন, সম্ভাব্য কার্বন বাজারে প্রবেশের জন্য আর্টিকেল ৬ অর্জনের প্রয়োজনীয়তা পূরণে চিহ্নিত ফাঁকগুলো পূরণ করতে এবং ৪০-এর ক্রেডিট অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আগামী তিন বছরে গৃহীত পদক্ষেপের একটি তালিকা তৈরি করেছে। মিলিয়ন টন কার্বন।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ। আলোচনায় বক্তৃতাকালে এমওইএফসিসি সচিব জোর দেন যে, বাংলাদেশি বেসরকারি খাতের সবুজ, বনায়নকেও বন হিসাবে বিবেচনা করা উচিত কারণ দেশটি একটি ভূমি-অপ্রতুল।
এমওইএফসিসি সচিব বলেন, কার্বন বাজার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও তথ্য থাকলে প্রত্যেক ব্যক্তি কার্বন ব্যবসার সুবিধা নিতে পারে। এই জ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তিনি যোগ করে বলেন, সকল নাগরিক এবং বেসরকারি সেক্টরের সচেতন হওয়া উচিত এবং কার্বন বাজার কী তা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা উচিত।
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, বৈশ্বিক কার্বন বাজারের সুযোগ গ্রহণে বাংলাদেশ দক্ষতা ও জ্ঞান নিয়ে এগিয়ে যাবে। এমওইএফসিসি কার্বন ব্যবসায় সাফল্য অর্জনের জন্য বেসরকারী খাতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে, তিনি আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, আমাদের একটি পরিকল্পনা রয়েছে যে, পরিবেশ তৈরি করার জন্য যেভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির সংরক্ষণ এবং প্রতিরক্ষামূলক পরিবেশের মাধ্যমে কম কার্বন ফুটপ্রিন্ট রয়েছে। আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং কার্বন প্রশংসাপত্রের অনুমোদনের জন্য জবাবদিহিমূলক হবে।
বিশ্বব্যাপী কার্বন বাজারের মূল্য ২০২৩ সালে ৮৮১ বিলিয়ন ইউরো (৯৪৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার) এর রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। কার্বন বাণিজ্য হল ক্রেডিট ক্রয়-বিক্রয় যা একটি কোম্পানি বা অন্য সত্তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করার অনুমতি দেয়। কার্বন ট্রেডিংকে কার্বন নিঃসরণ বাণিজ্য হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
অনেক আলোচনার পর, গ্লাসগো কপ-২৬ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে প্রথম বিশ্বব্যাপী একীভূত পদ্ধতির প্রণয়ন করে, গ্লাসগো কপ-২৬ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে একটি বৈশ্বিক কার্বন বাজারের নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সম্মত ফ্রেমওয়ার্ক, আর্টিকেল ৬ নামে পরিচিত, একটি কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা এবং একটি পৃথক দ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থা নিয়ে গঠিত। নতুন চুক্তির অধীনে, যারা কার্বন ক্রেডিট তৈরি করবে তারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য একটি তহবিলে উৎপন্ন আয়ের ৫ ভাগ জমা করবে।
ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চায় ক্ষতিগ্রস্তরা
এদিকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের শর্ত পূরণ হয়নি। এরমধ্যে এবার জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর কাছে বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলো।
আর জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত নির্বাহী পরিচালক সাইমন স্টিয়েল আসন্ন উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০ সম্মেলনের আগে শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন।
তিনি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোকে জলবায়ুসংক্রান্ত পদক্ষেপকে সম্মেলনের এজেন্ডার অগ্রভাগে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। সতর্ক করে তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট প্রতিটি জি-২০ দেশের জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে কপ-২৯ সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) নেতারা বছরে ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণের যে দাবি তুলেছে তা আদায়ের পথকে বেশ জটিল ও কঠিন মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, অর্থ ছাড় বা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বিগত বছরগুলোয় উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করেনি। ফলে এই সম্মেলনে এ বিষয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। অর্থ ছাড়ে উন্নত বিশ্বের দর-কষাকষির পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবে ক্ষতিপূরণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। ফলে সম্মেলনে অনুদান বা ক্ষতিপূরণের চেয়ে ঋণ দিতে আগ্রহী রাষ্ট্রগুলো। এরই মধ্যে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার সবুজ শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন সম্মেলনে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী নেতা, ব্যাংক ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা।
জলবায়ু সম্মেলনে ‘অর্থ, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য’র জন্য নির্ধারিত দিনে বিজনেস, ইনভেস্টমেন্ট এবং ফিলানথ্রপি ক্লাইমেট প্ল্যাটফর্ম থেকে (বিআইপিসিপি) বিনিয়োগসংক্রান্ত অর্থ ছাড়ের বিষয়ে বৃহৎ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকিং সেক্টর থেকে এই ঘোষণা করা হয়।
তবে বিপুল এই অর্থ ছাড়ে খুব একটা আশার বাণী দেখছেন না বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। বিনিয়োগ বা ঋণ নয়, বরং উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণ চাইছে এলডিসিভুক্ত দেশগুলো। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে আমাদের ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্জন করার কথা ছিল, সেটি ২০২৪ সালে এসেও সেই পরিমাণ অর্থ ছাড় হয়নি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডাপটেশন, মিটিগেশন, লস অ্যান্ড ড্যামেজ খাতে সহায়তা নয়, ঋণ দিতে চায় বিশ্বনেতারা। তবে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর দাবি ক্ষতিপূরণ।
বিআইপিসিপি জানায়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এই বাজারে বেসরকারি মূলধন স্থাপন এবং খাতটিকে আরও ফলপ্রসূ করতে বিশাল এই অর্থ বিনিয়োগের ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন কর্মসূচির জন্য ৩৫০ কোটি ডলার তহবিল ঘোষণা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এছাড়া আজারবাইজানের ব্যাংকিং খাত ২০৩০ সালের মধ্যে সবুজ প্রকল্পে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং সুইডেন জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিলে ৭৩০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছে। সুইডেনের অর্থ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় বিনিয়োগ করা হবে।
তবে বিপুল এই অর্থ ছাড়ে খুব একটা আশার বাণী দেখছেন না বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। বিনিয়োগ বা ঋণ নয়, বরং উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণ চাইছে এলডিসিভুক্ত দেশগুলো।
বাংলাদেশ ডেলিগেশন টিমের সদস্য ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০২০ সালের মধ্যে আমাদের ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্জন করার কথা ছিল, সেটি আমরা অর্জন করতে পারিনি। ২০২২ সালে উন্নত বিশ্ব বলছিল, ১১৬ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে, কিন্তু আমরা এই সংখ্যাকে বিশ্বাস করি না। অক্সফাম হিসাব করে দেখিয়েছে, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় এক-চতুর্থাংশের কম। তাই জলবায়ু অর্থায়নের ওপর আমি খুব আশাবাদী নই।’