পুত্রের সামনে পিতাকে মারতে ৫ হাজার টাকায় অংশ নেয় বহিরাগত ‘৪ কিলার’। সাবেক সংসদ সদস্য আউয়ালের হ্যাভেলি প্রোপার্টিজ কোম্পানির ম্যানেজার সুমন ব্যাপারী। তিনি মিরপুর এলাকায় ৫০ জনের মতো কিশোর গ্যাং সদস্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। সুমনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হচ্ছেন মনির ও রকি। আউয়ালের নির্দেশে সুমনসহ ১২/১৩ জন সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নেয়। এদের মধ্যে রকির মাধ্যমে মাত্র ৫ হাজার টাকা চুক্তিতে বহিরাগত ৪ কিলারকে ভাড়া করা হয়। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে শরিফ।
সাহিনুদ্দীন কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেওয়া কিলার মনির ও মানিক র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। তবে বহিরাগত ৪ জনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে গ্রেফতার হওয়া কিলার শরিফ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দিয়েছেন। শরিফ ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, মনির ও মানিক ছাড়াও শরিফসহ বহিরাগত ৪ জন কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল।
ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, পলাতক বহিরাগত সেই ৩ কিলারের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এখন তারা পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে পল্লবীর চাঞ্চল্যকর সাহিনুদ্দীন হত্যার ঘটনায় সাবেক সংসদ সদস্য আউয়ালসহ গ্রেফতার হয়েছেন ১০ জন। এরমধ্যে এজাহারভুক্ত গ্রেফতারকৃতরা হলেন- এম এ আউয়াল, সুমন ব্যাপারী, মো. টিটু, মো. দিপু, বাবু ওরফে বাইট্টে বাবু ও মো. মুরাদ। তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতাররা হলেন- রকি তালুকদার, নুর মোহাম্মদ হাসান, ইকবাল ও শরীফ।
গ্রেফতারদের মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তি জবানবন্দি দিয়েছেন। ৪ দিনের রিমান্ডে থাকা এম এ আউয়ালকে বুধবার (২৬ মে) আদালতে সোপর্দ করা হবে। বুধবার তিনি আদালতে স্বীকারোক্তি জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছেন বল দাবি ডিবি পুলিশের।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, সাবেক এমপি আওয়ালের আলীনগর প্রজেক্টের কার্যক্রম (বাউন্ডারি গেইট ও পিলার) পরিচালনার সময় ভিকটিম সাহিনুদ্দীনের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাহিনুদ্দীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুমনকে নির্দেশ প্রদান করে আওয়াল। আওয়ালের নির্দেশনা মোতাবেক সুমনের নেতৃত্বে পরিকল্পনা করা হয়।
গ্রেফতারদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেন, আউয়াল সুমনকে সাহিনুদ্দীনকে হাত-পা কেটে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চুক্তি অনুযায়ী অগ্রিম ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। কাজ সম্পাদন হলে আরও টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন আউয়াল। তবে খুনের পর চাঞ্চল্য ছড়ালে সেটা আর সম্ভব হয়নি, সবাই পালিয়ে যান।
হাফিজ আক্তার বলেন, মামলার পর তদন্তভার নেয় ডিবি মিরপুর। এজাহার নামীয় আসামি ২০ জন। সব মিলে ১০ আসামি গ্রেফতার রয়েছে। তদন্ত কাজও শেষ পর্যায়ে গুছিয়ে আনা হয়েছে। পলাতক বাকি আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে এটা স্পষ্ট যে, সাহিনুদ্দীন খুনে নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য আউয়াল।
এ ব্যাপারে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, হত্যার পাঁচ দিন আগে রাজধানীর কলাবাগানে সুলতানা টাওয়ারের তৃতীয় তলায় আউয়ালের অফিসে বসেই সাহিনুদ্দীনকে খুনের নীল নকশা করা হয়। আউয়াল দায়িত্ব দেন নিজস্ব ক্যাডার, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুমন বেপারীকে। সেখানে সাহিনউদ্দীনকে হত্যা করার জন্য আউয়াল সুমনের মাধ্যমে মনিরকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। আউয়াল বলেছিলেন মিশন শেষ করো, আরও টাকা দিব। ওই বৈঠকে সুমন ছাড়াও মনির, তাহের, কিবরিয়া, সজিব, টিটু ও বাবু উপস্থিত ছিলেন। সুমনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন রকি। রকির মাধ্যমে বহিরাগত শরিফসহ ৪ জনকে মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে ভাড়া করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীর পল্লবী এলাকার ল্যান্ড প্রোপার্টিজ দেখভাল, নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য সুমন ৫০ সদস্যের একটি গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতেন। হাভেলি প্রোপার্টি ডেভেলপার লিমিটেডের স্থায়ী সাইট ম্যানেজার ছিলেন সুমন। তিনি এমএ আউয়ালের হয়ে তিন বছর ধরে কাজ করছিলেন।
ডিএমপির গোয়েন্দা মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আহসান খান বলেন, মঙ্গলবার এমএ আউয়ালের চার দিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে। বুধবার তাকে আদালতে সোপর্দ করা হবে। পাশাপাশি তদন্তকারী দল গত সোমবার সাহিনুদ্দীন খুনের প্রত্যক্ষদর্শী শিশুপুত্র, স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যদের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইটভাটার বিল দেওয়ার কথা বলে সুমন গত ১৬ মে বিকেলে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৩১ নম্বর সড়কে সাহিনুদ্দীনকে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে শিশুপুত্রের সামনেই প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সাহিনুদ্দীনকে। ওই ঘটনায় তার মা আকলিমা বেগম ২০ জনকে আসামি করে পল্লবী থানায় মামলা করেন।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, সাহিনুদ্দীনের পরিবারের ১২ একর জমির দখল নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন সাবেক এমপি আউয়াল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। জমি দখল করতে পরিকল্পিতভাবে তাকে খুন করা হয়।