টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয় ৪ অক্টোবর। এর মধ্যে উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত গোয়াতলা ইউনিয়নের কয়েক গ্রামের বাসিন্দা আছেন মহাবিপদে। গত সাত দিনেও এ এলাকায় সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণই পৌঁছায়নি। খাবার সংকটে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন তারা।
স্থানীয়রা জানান, ইউনিয়নের কান্দাপাড়া, মাটিখলা, পাইববাজুড়ি, চুরবহুলী গ্রাম চারটি উপজেলার মূল সড়ক থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে। গ্রামগুলোতে যেতে আঞ্চলিক সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও বুকপানি। নৌকা নেই বললেই চলে, পানির মধ্যে হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা। এজন্য কোনো স্বেচ্ছাসেবী ওই এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যেতে চাচ্ছেন না। সরকারিভাবে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও ত্রাণ পৌঁছায়নি।
গতকাল বৃহস্পতিবার কান্দাপাড়া ও মাটিখলা গ্রাম দুটি ঘুরে দেখা যায়, চারদিকে পানি; কোথাও মাটির চিহ্ন নেই। কান্দাপাড়া গ্রামের উত্তরে কোনো কোনো বাড়িতে এখনও বুকপানি। এমন কোনো ঘর নেই যেটাতে পানি ঢোকেনি। কিছু পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পাশের উঁচু গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন।
কান্দাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ মীর কাশেম আলী বলেন, ‘সাত দিন অইয়া গেল, কাউর দেহা পাইলাম না। কেউ খোঁজ নিল না। চাইরখান (চারদিক) দিয়া অথই পানি, কই যামু আমরা? রান্দোন-খাওনের ব্যবস্থা নাই। আমরা এখন নিরুপায়।’
একই গ্রামের বাসিন্দা আবু সাঈদ বলেন, ‘ঘরে কোমরপানি। চার মেয়ে, এক ছেলেকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়া দিছি। রাস্তা দিয়ে ভেলা বা নৌকায় চলাচল করতে হয়। তাই চাইলেই বের হওয়া যায় না। এলাকার দোকানগুলোতেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নেই। কেউ সহায়তা নিয়েও আসেনি।’
ওই এলাকার প্রবীণ রহিমা খাতুন বলেন, আমি একা মানুষ কোনোমতে ভাঙা ঘরে থাকি। মানষের ঘরে চাইয়া-টাইয়া খাই। পানি আওনের পর থাইক্কা ঘরে রান্নাবান্না কিছু নাই। ঘরের খাটের ওপরেই বসে থাকি। প্রতিবেশীরা কিছু দিলে খাই, না হলে উপোস থাকি। সরকারি বা বেসরকারিভাবে আজ পর্যন্ত কেউ আমাদের দেখতেও আসল না– আমরা আছি, না পানিত ভাইসা গেছি।’
ধোবাউড়া মূল সড়ক থেকে মাটিখলা আঞ্চলিক রাস্তায় ঢোকার মুখে দেখা মেলে রাহুল, সাদ্দাম, সিয়াম, শুভ নামে চার কিশোরের সঙ্গে। তারা জানায়, শহর থেকে লোকজন গেলে তারা এখান থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করে। ওই লোকদের ত্রাণ নিয়ে ভেতরের গ্রামগুলোতে যেতে বললেও যায় না।
পশ্চিম মাটিখলা গ্রামে ঢোকার পরে দেখা যায়, স্থানীয় মনজুরুল ইসলাম বন্যার পানি আটকাতে ঘরের দরজায় সামনে কলাগাছ কেটে বেড়া দিচ্ছেন। তবে কোনোভাবেই পানি আটকাতে পারছেন না।
ওই সময় আবুল কাশেম (৬০) নামে একজন আসেন কলাগাছের ভেলায় চড়ে। কাছে এসে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করছি, আপনেরা কিছু লইয়া আইছুন।’ পরে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার দুই ছেলে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। আমি কিছু জমিতে চাষ করছিলাম। এইডাও পানি খাইয়া গেছে (তলিয়ে গেছে)। ঘরে খাওয়ার কিছু নাই। আজ সকালে আমরা দু’জনে (স্বামী-স্ত্রী) দুইডা রুটি পানি খাইছিলাম। এইডা খাইয়া সারাদিন আছি।’
গ্রামের সুরুজ মিয়া বলেন, এ এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কৃষক, দিনমজুর ও অটোরিকশাচালক। সবাই এখন কর্মহীন। খাবার ম্যানেজ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সড়কও তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া গবাদি পশু নিয়েও সবাই বিপাকে আছে। রাখারও জায়গা নেই, গো-খাদ্যেরও সংকট।
তিনি অভিযোগ করেন, তাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওই গ্রামগুলোতে ভোট পান না দেখে কোনো সহযোগিতা করেননি। আবার এলাকাটি প্রত্যন্ত হওয়ায় বেসরকারি ত্রাণও পৌঁছায়নি। মহাসড়কের পাশ দিয়ে ত্রাণের সব গাড়ি চলে যায়। অথচ এই এলাকার মানুষের চাল, ডাল জাতীয় ত্রাণ সহায়তা খুব দরকার।
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও রাজনৈতিক সংগঠনও ত্রাণ দিচ্ছে। যেসব এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছায়নি, দ্রুত পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।