সড়ক নির্মাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিটুমিন আমদানির আড়ালে বিগত ১০ বছরে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ‘ওভার ইনভয়েসিং’ বা আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচারের পাশাপাশি দেশ হারাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংকের রিজার্ভ। বিটুমিন আমদানির আড়ালে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের মতো বিষয়ে তদন্ত করে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টন বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড দেশে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিটুমিন উৎপাদন করে যা চাহিদার মাত্র ১৩ শতাংশের মতো। অর্থ্যাৎ বাকি অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার বিটুমিনের প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে তিন লাখ ১৯ হাজার ৬৬১ টন বিটুমিন আমদানি করেছে ৪২টি প্রতিষ্ঠান। ৩৪৬টি ভিন্ন ভিন্ন চালানে আনা এই বিটুমিনের ‘অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু’ ছিল প্রায় এক হাজার ১১০ কোটি টাকা। বাল্ক এবং ড্রামে আমদানি করা এসব বিটুমিন কাস্টমস থেকে খালাস করা হয় উন্নতমানের ৬০/৭০ গ্রেড ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু এগুলোর মান নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ। প্রকৃতপক্ষে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলে তা খুবই টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথা, যা বাস্তবে দেখা যায় না। আর তাই সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন উঠে এসব বিটুমিনের গুণগত মান নিয়ে।
বিটুমিন আমদানিকারকদের একটি অংশ এসব বিটুমিনকে উন্নত মানের ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন বললেও অনুসন্ধানে দেখা যায় ভিন্ন তথ্য। ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় এসব বিটুমিনের কোনো কোনোটির গ্রেড পাওয়া গেছে ১০২, কোনোটির ৯৫, আবার কোনোটির ৯৮। বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে আলকাতরার চেয়েও নিম্নমানের বলে দাবি করছেন। ইসলামিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুস সাকিব বলেন, আমরা আমাদের দেশের সড়কগুলোতে বিটুমিনের নামে এক ধরনের আবর্জনা ব্যবহার করছি। আমদানি করা বিটুমিন যথাযথ পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে দেশে ঢোকানো হয় না। যতটুকু পরীক্ষা করা হয় তার পদ্ধতি পুরনো। ফলে উন্নতমানের বিটুমিন থেকে নিম্নমানের বিটুমিন আলাদা করা যায় না। আমদানিপত্রে বিটুমিনের বিষয়ে যেসব ‘স্পেসিফিকেশন’ লেখা থাকে সেগুলো আসলেও ঠিক কি না সে বিষয়টি অজানাই থেকে যায়।
সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারাও বলছেন, আমদানি করা বিটুমিনের কোনো মানই নেই। বিএসটিআই, বুয়েট ও বিপিসির কোনো অনুমোদন ছাড়াই এগুলো খালাস হয়ে হরহামেশা ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে রাস্তা কোনোভাবেই টেকসই হচ্ছে না। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিবিদ ও এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এসব বিটুমিনকে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেড ঘোষণা দেওয়া একটি পরিকল্পিত কৌশলমাত্র। আসলে পুরো ঘটনাটি বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রাপাচারের একটি ফাঁদ।
আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাই করে দেখা গেছে, ৮০ থেকে ১০০ গ্রেড মানের বিটুমিনের বাজারমূল্য টনপ্রতি ১৫০ থেকে ১৮০ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। গড়ে ১৬০ ডলার বা ১৩ হাজার ৬০০ টাকা দর বিবেচনায় ৯ মাসে আমদানি করা বিটুমিনের প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় ৪৩৪ কোটি ৭৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬০০ টাকা। অথচ ৯ মাসে আমদানিকারকরা বিদেশে পাঠিয়েছেন প্রায় এক হাজার ৫২২ কোটি টাকা।
এনবিআরের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে খালাস করা বিটুমিনের টনপ্রতি মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে গড়ে ৫৬০ ডলার বা ৪৭ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন বিটুমিনের বিপরীতে বিদেশে পাঠানো হয় বাড়তি ৩৪ হাজার টাকা। ফলে বিটুমিনের প্রকৃত মূল্যের বাইরে বাড়তি প্রায় এক হাজার ৮৭ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতিবছর গড়ে চার লাখ ২০ হাজার টন বিটুমিন আমদানি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ হিসাবে প্রকৃত মূল্যের বাইরে প্রতিবছর বিদেশে পাচার হচ্ছে অন্তত এক হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ১০ বছরে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২৮০ কোটিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অংক পাচার হওয়ার অংকের ন্যূনতম সংখ্যা। অধিকতর যাচাইবাছাই করা হলে প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরও আকার ধারণ করবে। বিটুমিন আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানে না বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে এ বিষয়ে তদন্ত করার আশ্বাস পাওয়া গেছে।
বিএফআইইউ এর প্রধান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, বিটুমিন আমদানিকারকরা যদি অর্থ পাচার করে থাকেন, তাহলে সেটি দেখার আইনগতভাবে দায়িত্ব আছে আমাদের। অর্থপাচার বিষয়ক বা মানি লন্ডারিং কিংবা সন্ত্রাসে অর্থায়ন—এগুলো প্রতিরোধের দায়িত্ব কেন্দ্রীয়ভাবে বিএফআইইউকে দিয়েছে সরকার। কিন্তু এই বিষয়টি এখনো আমাদের নজরে কেউ আনেনি। আমি এ বিষয়ে ইউনিটে খবর নেব। মানি লন্ডারিং নিয়ে কোনো অভিযোগ কিংবা গণমাধ্যমে কোনো রিপোর্টে এলে সেটি নিয়ে আমরা কাজ করি। আমরা সেগুলো তদন্ত করি ও সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সবাইকে এ অভিযোগ তদন্ত করার জন্য প্রেরণ করি। সুতরাং নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির আড়ালে যদি অর্থপাচার হয়ে থাকে, এমন কোনো রিপোর্ট হলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ৪২টি প্রতিষ্ঠান ৩৪৬টি চালানে বিটুমিন আমদানি করেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য মতে, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) আমদানি করা বিটুমিনের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৮০ হাজার ২৭৫ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল চার লাখ ২০ হাজার ৭৪১ টন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্রেড ভেদে মূল্য অনেক রকম হলেও সব মানের বিটুমিনের ডিউটি একই। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অল্প দামে নিম্নমানের বিটুমিন এনে উন্নত মানের বিটুমিন উল্লেখ করা হয়। বিদেশে টাকাও পাঠানো হয় উন্নত মানের দর অনুযায়ী।
জানা গেছে, ড্রামে পেট্রোলিয়াম বিটুমিন আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি প্রতি টনে সাড়ে চার হাজার টাকা নির্ধারিত। এছাড়া এর সাথে ২ শতাংশ আগাম আয়কর (এআইটি) এবং ৫ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) দিতে হয়। তবে বাল্ক আকারে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি টনে সাড়ে তিন হাজার টাকা নির্ধারিত এবং ২ শতাংশ এআইটি এবং ৫ শতাংশ এটি দিতে হয়। বিটুমিনের চাহিদার তুলনায় দেশীয় উৎপাদন কম হওয়ায় যে ঘাটতি দেখা দেয়, তার সুযোগে দেশে গড়ে উঠেছে আমদানিকারকদের একটি শক্তিশালী চক্র। অর্থপাচারের কৌশল জিইয়ে রাখতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিন ব্যবহারের সরকারি নির্দেশনাকেও পাত্তা দিচ্ছে না সংঘবদ্ধ চক্রটি। ফলে আমদানি করা মানহীন ও ভেজাল বিটুমিন ব্যবহার একটুও কমেনি।
ইস্টার্ন রিফাইনারির কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি করা বেশির ভাগ বিটুমিনই ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের। বিটুমিন আমদানির এলসি খুলে কার্যত আনা হয় ভেজাল কেরোসিন মেশানো আলকাতরা। কিন্তু আমদানিকারকরা ঠিকই উন্নত গ্রেড দেখিয়ে সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করছেন। বিপিসির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএসটিআই, বুয়েট ও বিপিসির কোনো অনুমোদন ছাড়াই ভেজাল বিটুমিন বন্দর থেকে খালাস করা হচ্ছে। ফলে কোনো রকম পরীক্ষায় অবতীর্ণ না হয়েও খুব সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে অসাধু সিন্ডিকেটটি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিটুমিন আমদানির আড়ালে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। অর্থাৎ যে দামে বিটুমিন কেনা হচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি দাম দেখানো হচ্ছে। এখানে অতিরিক্ত টাকাটা বিদেশে পাঠিয়ে বা পাচার করে দেওয়া হচ্ছে।
নিম্নমানের বিটুমিন প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমি যখন দাম কম দিয়ে কিনব, তখন অবশ্যই আমি নিম্নমানের জিনিস পাব। এটা খুবই স্বাভাবিক। গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটে ব্যবহার করা বিটুমিনের মান খুবই খারাপ। এক বছরের মধ্যে এসব রাস্তা ধসে যায়, দেবে যায় এবং টান দিলে পুরোটা উঠে যায়। ’তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়, পৃথিবীর কোনো দেশে এগুলো ব্যবহার করা হয় না। সুতরাং বিটুমিনের ন্যূনতম মান নিশ্চিত করা উচিত। ’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে অর্থপাচার আগেও ছিল, এখনো আছে। আমরা সব সময় পরামর্শ দিয়ে থাকি যে ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার সময় কী মূল্যমানের কী খোলা হচ্ছে, সেটি দেখা এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের তথ্য-উপাত্তগুলো খতিয়ে দেখা। ওই মূল্যমানের পণ্য যেটি আমদানিকারকরা ঘোষণা দিচ্ছেন, সেটি ঠিক আছে কি না, সেগুলো ক্রস চেক করে দেখা উচিত। বিশেষ করে মান ও দামের ক্ষেত্রে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না, তা দেখা উচিত। বিটুমিন আমদানিকারকদের এখানে একটি সিস্টেমের ভেতরে আনতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমদানিকারকদের এখানে দুটি বিষয় আছে। একটি হলো তারা নিম্নমানের বিটুমিন এনে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। আরেকটি হলো প্রক্রিয়াগতভাবে ওভার ইনভয়েসিংয়ের কারসাজি। এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃত মূল্য ও অতিরিক্ত মূল্যের মধ্যে যে ফারাক থাকে, তা দেশের বাইরে পাচার করা হয়।
তিনি বলেন, নিম্নমানের বিটুমিন আমদানিকারকদের এ প্রক্রিয়ায় অর্থপাচার ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে ঘোষিত পণ্যের দাম ও কোয়ালিটি বিশ্ববাজারে যাচাই করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। একই সঙ্গে তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এ প্রক্রিয়ায় অর্থপাচার বন্ধ করা যাবে না।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আরও বলছেন, মানহীন বিটুমিন ব্যবহারের কারণে সড়ক মেরামত ব্যয় গত এক দশকে অন্তত চার গুণ বেড়েছে। আমদানি করা ভেজাল বিটুমিন ব্যবহার ঠেকাতে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। তবু এটি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার বন্ধে বড় বাধা আমদানিকারকদের একটি সিন্ডিকেট। তারা কম দামে নিম্নমানের বিটুমিন এনে অনুমোদন ছাড়াই নানা কৌশলে খালাস করছে। একদিকে অর্থপাচার হচ্ছে, অন্যদিকে নিম্নমানের ভেজাল বিটুমিনে ক্ষতির মুখে সড়ক-মহাসড়ক। এতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে সরকার। গুটিকয়েক আমদানিকারকের লোভের মাসুল দিচ্ছে দেশের মানুষও।