টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতিতে রেকর্ড করেছে। বিশেষ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পুকুরচুরি হয়েছে, যার দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী শাসনামলে প্রায় ১৫ বছরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২৯ হাজার কোটি থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। ‘সড়ক মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি বুধবার (৯ অক্টোবর) রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।
টিআইবির গবেষণাটিতে ঠিকাদার, সড়ক বিভাগের আমলা ও প্রকৌশলীসহ ৭৩ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এবং ৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসবের ভিত্তিতে টিআইবি একটি প্রকল্পে মোট বরাদ্দের কত শতাংশ ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ব্যয় হয়, তা হিসাব করেছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে সমাপ্ত প্রকল্পগুলো গবেষণাটির আওতায় আনা হয়েছে। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরুর সময় ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত।
সড়ক নিয়ে গবেষণাটি করেছেন টিআইবির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মো. জুলকারনাইন ও গবেষণা সহযোগী মো. মোস্তফা কামাল। তারা দুজনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে জানান, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সড়ক ও সেতু খাতে সরকারের মোট অর্থ বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ব্যয়ের ৭২ শতাংশ কাজ পেয়েছে ১৫টি ঠিকাদার।
টিআইবি বলছে, ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৎকালীন মন্ত্রী, কয়েকজন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। এর ফলে ঠিকাদারেরা নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করেছেন। উপকরণ যতটুকু দরকার, তার চেয়ে কম ব্যবহার করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ও প্রকৌশলীরা এই অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন।
টিআইবি জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা সরাসরি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুকূল্য পাওয়ায় নিম্নমানের কাজ করা বা প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির জন্য তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না। কয়েকজন ঠিকাদারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত নেই।
টিআইবি আরও জানায়, কিছু ঠিকাদারের রাজনৈতিক প্রভাব ও উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। জালিয়াতি করায় গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ৩৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তবে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ পেয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনস্বার্থে নেওয়া প্রকল্পগুলোতে রাজনীতিবিদ, আমলা ও ঠিকাদারদের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাত রয়েছে। একেবারে নিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত এসব দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের নানা প্রকল্পের তথ্য চাইতে গেলে অনেক তথ্য আমাদের দেওয়া হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা, যেসব তথ্য প্রকাশযোগ্য, সেগুলো যেন প্রকাশ করা হয়। তবে বাস্তব কথা হলো প্রতিষ্ঠানে কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে, তবে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার তো পরিবর্তন হয়নি। তাই রাতারাতি পরিবর্তন আশা করছি না।