সমবায় ব্যাংকে সোনা জমা বা বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন সাধারণ গ্রাহকেরা। গ্রাহকদের সেই সম্পদ ভুয়া মালিক সাজিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। তাঁর নাম মহিউদ্দিন আহমেদ, যিনি যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (দক্ষিণ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
নথিপত্র বলছে, সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় ২০২০ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ মোট ৭ হাজার ৩৯৮ ভরি সোনা বিক্রি করে দেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যাংকটির ২ হাজার ৩১৬ জন গ্রাহক।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহিউদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে চলে গেছেন।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার মন্তব্যের পর নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সমবায় ব্যাংকে সোনা বন্ধক রাখা গ্রাহকদের মধ্যে। গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার মতিঝিলে সমবায় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনেক গ্রাহক জড়ো হন। অনেকে বন্ধক রাখা সোনা দেখানোর দাবি করেন।
সমবায় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক আহসানুল গনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক যে ২০২০ সালে বন্ধককৃত সোনা বিক্রি নিয়ে অনিয়ম হয়েছে। দুদকের প্রতিবেদনেও তা উঠে এসেছে।
যেভাবে জালিয়াতি
সমবায় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক নয়। এটি বিশেষায়িত ব্যাংক। পরিচালিত হয় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনে।
সমবায় ব্যাংকে সোনা বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া যায়। প্রতি ভরি খাঁটি সোনার (খাদ বাদে) বিপরীতে এখন ৫৫ হাজার টাকা ঋণ পাওয়া যায়। সুদের হার ১৭ শতাংশ। বাড়তি ১ শতাংশ বিমা খরচ দিতে হয়। ঋণ নেওয়ার পর সুদ ও আসল টাকা পরিশোধ করে সোনা ফেরত নিতে পারেন গ্রাহকেরা। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে ঋণের টাকা শোধ করতে না পারলে বন্ধক রাখা সোনা নিলামে বিক্রি করা যায়।
দুদকের মামলার এজাহার বলছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর সময়ে সমবায় ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বন্ধক রাখা সোনা নিলামে না তুলে ভুয়া মালিক সাজিয়ে বিক্রি করে দেন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করা হয়। মহিউদ্দিন আহমেদকে জালিয়াতিতে সহায়তাকারীদের একজন সমবায় ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) নুর মোহাম্মদ। তিনি মহিউদ্দিন আহমেদের ভাগনে। দুদকের মামলায় নুর মোহাম্মদ ৬ নম্বর আসামি। মামলাটি এখন বিচারাধীন।
মহিউদ্দিন আহমেদ সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন ২০০৯ সালে। তখন তিনি যুবলীগের নেতা ছিলেন। সমবায় সমিতি আইনে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের তিন মেয়াদের বেশি থাকার সুযোগ নেই। সে হিসাবে চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাঁর ২০১৮ সালে বিদায় নেওয়ার কথা। যদিও ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। ২০২২ সালে তিনি সমবায় ব্যাংক থেকে বিদায় নেন।
দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২০ সালে মতিঝিলে সমবায় ব্যাংকের সদর দপ্তরে জমা রাখা সোনা ফেরত নিতে অনেক গ্রাহক আবেদন করেন। এর মধ্যে ৪৫৫টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে দুদক। তাতে দেখা যায়, ৩৩৫টি আবেদনপত্রে মূল নথিপত্রের সঙ্গে স্বাক্ষর ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মিল নেই। অর্থাৎ, ভুয়া মালিক সাজিয়ে সোনা ফেরত নেওয়া হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। পরে সেই সোনা বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ব্যাংকের প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করে বাকি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
জালিয়াতি করে ঢাকা সমবায় অফিসে বিক্রি করা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৪ ভরির কিছু বেশি সোনা। অন্যদিকে সমবায় ব্যাংকের সদস্য প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড সোনা বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেখানকার সোনা পুনঃ বন্ধক রাখে সমবায় ব্যাংক। দুদকের মামলার এজাহার বলছে, নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেডের ৫ হাজার ৮০৩ ভরির কিছু বেশি সোনা একই কৌশলে বিক্রি করে দেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেডে ২০১১ সালে আট ভরি সোনা বন্ধক রেখে ৯৩ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন রাজধানীর স্বামীবাগ এলাকার বাসিন্দা কাকলি জাহান। পরে ঋণের সুদ ও আসল বাবদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা দিয়ে সোনা ফেরত আনতে গেলে তাঁকে তা দেওয়া হয়নি। এক বছর ধরে ঘুরছেন তিনি।
কাকলি জাহানের জমা রাখা সোনার এখনকার বাজারমূল্য প্রায় ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তিনি সমিতিতে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন। কোনোটাই ফেরত পাচ্ছেন না। গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সমবায় ব্যাংকে আমার কিছু সোনা বন্ধক রাখা আছে। সমবায় উপদেষ্টার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, সেটাও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।’
অভিযোগপত্র থেকে নাম বাদ
দুদকের মামলার এজাহারে ১ নম্বর আসামি ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তাঁকেই সোনা বিক্রি করে দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু অভিযোগপত্র থেকে তাঁর নাম পুরোপুরি বাদ দেয় দুদক।
অভিযোগপত্রে ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় আটজনকে। তাঁরা হলেন সমবায় ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক আবদুল আলীম, সহকারী মহাব্যবস্থাপক হেদায়েত কবীর, সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. আশফাকুজ্জামান, সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার মাহাবুবুল হক, প্রিন্সিপাল অফিসার ওমর ফারুক, সিনিয়র অফিসার নুর মোহাম্মদ, সহকারী অফিসার আবদুর রহিম ও সহকারী অফিসার নাহিদা আক্তার।
সমবায় ব্যাংক অভিযোগপত্রে নাম থাকা আটজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। তাঁরা সবাই জামিনে আছেন।
মামলার এজাহারের ১ নম্বর আসামির নাম অভিযোগপত্র থেকে কীভাবে বাদ পড়ল, সে বিষয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, এটি বিচারাধীন বিষয়। এ বিষয়ে মন্তব্য করবেন না।
মহিউদ্দিনের আরও অনিয়ম-দুর্নীতি
মহিউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে আরও অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে সমবায় ব্যাংকের ১০ তলা একটি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণেও অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩১ কোটি টাকা। তার চেয়ে পাঁচ কোটি টাকা বেশি খরচ করেন চেয়ারম্যান। বাড়তি টাকা খরচের আগে ও পরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ কারও কাছ থেকে অনুমোদন নেননি তিনি। ভবনটির স্পেস (জায়গা) বরাদ্দের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সমবায় অধিদপ্তরের একটি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহিউদ্দিন আহমেদ ওই ভবনের জায়গা একাংশ বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের স্বজনদের কাছে ভাড়া দেন। বর্গফুটপ্রতি ভাড়া নেওয়া হয় মাত্র ২১ টাকা। স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে প্রতি বর্গফুট জায়গার ভাড়া অন্তত ১০০ টাকা।
১০ তলা ওই ভবনটির আরেকাংশ আরেক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে বর্গফুটপ্রতি ৫ টাকা করে। চার বছর ধরে তারা ভাড়া পরিশোধ করছে না।
নিয়োগে অনিয়ম
সমবায় ব্যাংকে ২০১০ থেকে ২০১৮ সময়ে বিভিন্ন পদে ১৭৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন তৎকালীন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ। সমবায় ব্যাংক গত সপ্তাহে স্থানীয় সরকার ও সমবায় উপদেষ্টাকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলেছে, মহিউদ্দিন আহমেদ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করে এই নিয়োগগুলো দিয়েছেন। নিয়োগ পাওয়াদের বড় অংশের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়, যেটি মহিউদ্দিন আহমেদের জন্মস্থান। ৬৩ জন তাঁর স্বজন ও আত্মীয়।
সমবায় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, মহিউদ্দিন আহমেদের সময় নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের অধিকাংশই অদক্ষ, অসৎ ও উচ্ছৃঙ্খল। তাঁদের অন্তত ১৩০ জন গৃহনির্মাণ ঋণ নিয়েছেন। অনেককেই প্রাপ্যতার চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে। ঋণের বিপরীতে উপযুক্ত জামানতও নেই। ফলে সমবায় ব্যাংক প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে। উল্লেখ্য, সমবায় ব্যাংকের কর্মীরা ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণ পান।
সমবায় ব্যাংকের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের এসব ঘটনা এখন আর অবাক ও বিস্মিত করে না। কারণ, কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের চর্চাই ছিল এটি। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংকের জালিয়াতি হয়েছে তৎকালীন শীর্ষ ব্যক্তিদের যোগসাজশেই। তাঁরা বহুমাত্রিক দুর্নীতি করেছেন।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, দুদক ক্ষমতাসীনদের যে কিছুই করতে পারে না, সমবায় ব্যাংকের ঘটনা সেটির একটি উদাহরণ মাত্র।