বাংলাদেশের মাছ উৎপাদনে প্রায় ১২ শতাংশই ইলিশ মাছের অবদান রয়েছে, এবং জাতীয় উৎপাদনের এক শতাংশেরও বেশি জিডিপিতে এই মাছের অংশ। জেলেরা প্রতি বছর ৬ লাখ টন ইলিশ ধরে, যা মূলত সমুদ্র থেকে আসে। ২০১৭ সালে ইলিশ মাছকে বাংলাদেশের একটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ আগামী অক্টোবরে তাদের বড় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই উৎসবে ইলিশ মাছ ভারতের বাঙালিদের একটি পছন্দের খাবার। তবে এবার পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হয়তো তাদের প্রিয় ইলিশ মাছ পাবেন না। বিবিসির খবরে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ এই বছর ভারতের জন্য ইলিশ মাছ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, “ঢাকায় নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ইলিশ মাছ যেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য হয়, এজন্য নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।” তিনি বিবিসিকে জানান, “নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনেক মাছ বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছে। এবার আমরা ইলিশ মাছ সীমান্ত পার হতে দেব না।”
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হলেও এটি অনেক দামি। সাধারণত ধনী ও মধ্যবিত্তরা এই মাছ কিনতে পারে, নিম্নবিত্তদের জন্য এটি সাধ্যের বাইরে। আখতার বলেন, “আগের সরকার দুর্গাপূজার সময় নিষেধাজ্ঞা তুলে নিত। তারা এটিকে উপহার হিসেবে দেখাত। তবে এবার আমাদের উপহার দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ যদি আমরা প্রচুর রফতানির অনুমতি দিই, তাহলে আমাদের দেশের মানুষ ইলিশ খেতে পারবে না।”
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে ‘ইলিশ কূটনীতি’ ছিল ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শেখ হাসিনা উৎসবের মৌসুমে ভারতকে ইলিশ রফতানির অনুমতি দিতেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে একাধিকবার ইলিশ পাঠিয়েছেন। ২০১৭ সালে, ভারত-বাংলাদেশ অভিন্ন নদী সমস্যা সমাধানের আশায় তিনি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে ৩০ কেজি ইলিশ উপহার দিয়েছিলেন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনা ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে সদিচ্ছার সম্পর্ক রাখতে চাইলেও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করছে।
মৎস্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, “বিগত বছরগুলোতে দুর্গাপূজার সময় বছরে তিন থেকে পাঁচ হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।” তবে এ বছর দেশে মাছের অভাবের কারণে সরকার ইলিশ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
নতুন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, বাংলাদেশি বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে গেছে। একটি দেড় কেজি ইলিশ মাছ প্রায় ১৮০০ টাকা (১৫ ডলার; ১১.৫০ পাউন্ড), ১ কেজি ২০০ গ্রাম মাছ ১৬০০ টাকা এবং এক কেজি মাছ ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, গত বছরের তুলনায় দাম দেড়শ’ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে।
মৎস্যজীবীরা দাম বৃদ্ধির কারণ জানাতে পারছেন না। হোসেন মিয়া নামে একজন জেলে বলেন, “গত তিন মাসে আমরা পাঁচবার সমুদ্রে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফিরে আসতে হয়েছে।”
সীমান্তের দুই পাড়ের বাঙালিদের কাছে ইলিশ খুব প্রিয় খাবার, তাই এবছর এর অভাব অনেককে হতাশ করবে। ইলিশের বহুমুখী স্বাদের জন্য এটি বিখ্যাত, এবং বিভিন্ন উপায়ে রান্না করা হয়, যেমন লবণ ও হলুদ-মরিচ দিয়ে ভাজা এবং সরিষার বাটা দিয়ে ভাপা ইলিশ।
বাঙালি-আমেরিকান খাদ্য ইতিহাসবিদ চিত্রিতা ব্যানার্জী ইলিশ মাছ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “বাঙালি খাবারের আইকন হিসেবে ইলিশের স্থায়িত্ব অনেক কারণে। এর মধ্যে একটি হলো এর শারীরিক সৌন্দর্য, যা বাঙালি লেখকদের ‘জলের প্রিয়তমা’ বা ‘মাছেদের যুবরাজ’ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।” সূত্র: বিবিসি