কুমিল্লা সদর উপজেলার বদরপুর গ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী অনিক চন্দ্র দাস। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে চতুর্থ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী বাড়ি ফিরে দেখেন ভিজে গেছে তার সব বই-খাতা। সেইসঙ্গে তার বোন জয়ার বই-খাতারও একই অবস্থা। ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য বাড়ির সামনে থাকা স্পিড বোটে বই-খাতাগুলো শুকাতে দিয়েছে অনিকের বাবা-মা। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হচ্ছে না দেখে মন খারাপ অনিকের।
সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় স্কুলছাত্র অনিকের। সে বলে, ‘স্কুলে যেতে চাই খুব দ্রুত। সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাও করা যাবে। কিন্তু এখন যদি স্কুল খোলে তবে আরেক বিপদ। কারণ, সব বই-খাতা তো ভিজে গেছে। বাবাকে বলতে হবে নতুন বই কিনে দেওয়ার জন্য। নতুন বই-খাতা কিনতে না পারলে স্কুলে গিয়ে তো কোনো লাভ নেই।’
অনিক জানালো তার সহপাঠীদের অবস্থাও প্রায় একইরকম। একই অবস্থা বুড়বুড়িয়া গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা জিমেরও। ১২ দিন বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে তার বাড়ির অনেক কিছুই। বাড়ি ফিরে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে খুঁজে পায় তার স্কুলব্যাগ আর বই-খাতা। তবে পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে সব। তার ভাই-বোনেরও স্কুলব্যাগ ও বই-খাতার একই দশা।
বুড়িচং উপজেলার নানুয়ার বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা সারাবাংলাকে বলে, ‘আমার দুই বোনের বই-খাতাসহ সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন স্কুল খুললেই যেতে পারব না।’ বন্যা কবলিত এলাকাগুলোর শিক্ষার্থীদের অনেকের মনেই এখন এমন আক্ষেপ।
বন্যার পানি নেমে গেলেও হুমকির মুখে পড়েছে বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থা। ঘরবাড়ি হারানো শিক্ষার্থীদের অনেকেই হারিয়েছেন বই-খাতার পাশাপাশি স্কুল কলেজের পোশাকও। দুর্যোগে অনেকেরই বাবা মায়ের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষাজীবনও বন্ধের পথে। চোখের সামনে সব হারিয়ে মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত শিশু-শিক্ষার্থীরা।
কুমিল্লা শিক্ষা বিভাগের তথ্য মতে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের চার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবকাঠামোগত ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেজন্য দ্রুতই স্কুলগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে কুমিল্লা জেলায় মোট ৪৩২টি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেরামত ছাড়া ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতদিন বন্যার পানি থাকবে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তাদের আশঙ্কা, অবকাঠামোগত ক্ষতির কারণে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল না হওয়ায় স্কুল-কলেজ বিমুখ হতে পারেন অনেকেই।
বুড়িচং উপজেলার খাড়াদাতাইয়া মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মিনুয়ারা আক্তার সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানান, অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারই বন্যার কারণে একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের ঘুরে দাঁড়ানো কষ্টকর। শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছে। তাদের আবার স্কুলমুখী করতে পরিবারের লোকজনকে বোঝাতে হবে এবং শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্দি করা হবে।
বুড়িচং উপজেলারই সোনার বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা সৌরভ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিজের চোখের সামনে বাড়ি ঘর ভেঙে যেতে দেখে শিশু-শিক্ষার্থীরা এক ধরনের মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। তাদের সহযোগিতা করে আবার স্কুলে ফেরাতে হবে ‘
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য মতে, সাম্প্রতিক বন্যায় ১০৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ ২০৫টি এবং ১২৩টি মাদরাসা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিগগিরই চালু করা যাচ্ছে না।
তবে শিক্ষার্থীরা যেন স্কুল কলেজে ফিরতে পারে সেজন্য সরকারি সর্বোচ্চ সহযোগিতার কথা জানালেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যাদের বইখাতা ও স্কুল-কলেজের পোশাক হারিয়েছে আমরা তাদের সহযোগিতা করব। যারা খাদ্য সংকট আছে তাদেরকেও সাহায্য করা যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক স্কুল-কলেজের সংযোগ সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো ঠিক করতে হবে। এ ছাড়া একতলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট হয়েছে। সেগুলো ঠিক না করে পাঠদান শুরু করা যাবে না। আমরা এখনো তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে সব এলাকা থেকে পানি নেমে গেলে মোট ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা জানা যাবে।’