ঢাকায় শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও তার দেশ ছাড়ার ঠিক দিন ১৫ আগের কথা। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি বাতিল করার ঠিক পরদিন দিল্লিতে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘ডিসটার্বিং ইন ঢাকা’।
ওই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছিল, “কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে যে সহিংসতা দেখা যাচ্ছে, তা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী রাজনীতিরই উপসর্গ। ভারতের এখন সময় এসেছে হাসিনার পর কী, তা নিয়ে ভাবার!” (‘ইন্ডিয়া মাস্ট থিংক বিয়ন্ড হাসিনা’)।
বিগত দেড় দশক ধরে ভারতের বাংলাদেশ নীতি আর শেখ হাসিনা যেভাবে প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল, তাতে দিল্লির একটি মূল ধারার শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ভারতকে ‘বিয়ন্ড হাসিনা’ ভাববার পরামর্শ দিচ্ছে – সেটা তখনও কিন্তু প্রায় অকল্পনীয় ছিল।
ওই সম্পাদকীয় প্রকাশিত হওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহের মাথায় ঢাকায় নাটকীয় পটপরিবর্তনের মাধ্যমে ভারতকে কিন্তু এখন ঠিক সেটাই করতে হচ্ছে – বা বলা ভালো, হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে ভারত কী কৌশল নিয়ে এগোবে – দিল্লি সেটা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।
শেখ হাসিনা চিরকাল ঢাকার ক্ষমতায় থাকবেন না, এটা জানা থাকলেও সেই দিন যে এত তাড়াতাড়ি আসবে ভারত আসলে তা ভাবতেই পারেনি।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওই সম্পাদকীয় থেকে আরও কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করা যাক : “আজকের বাংলাদেশ আসলে গণতন্ত্রের মৌলিক চেক-বক্সগুলোতে টিক দিতেই ব্যর্থ হয়েছে – যেগুলো হলো একটি কার্যকরী বিরোধী পক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচারবিভাগ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনরোষ ভারতের জন্যও একটি নিরাপত্তাগত দ্বিধা বা সংকট তৈরি করেছে।”
“আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলে তার জায়গায় একটি পাকিস্তান-সমর্থিত সরকার আসুক, ভারত আর যাই হোক এটা কোনও মতেই চাইবে না। ফলে তাদের এখনই দিশা পাল্টাতে হবে, নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রক্ষা করতেই বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি শ্রেণির কাছেই তাদের রিচ আউট করতে হবে।”
ভারতে ক্ষমতার অলিন্দে শীর্ষ কর্মকর্তারা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, তখন এ সতর্কবার্তা অনেকটা ‘প্রোফেসি’ বা ভবিষ্যদ্বানীর মতো শোনালেও, ওই সম্পাদকীয়র প্রায় প্রতিটি কথা এখন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে।
ফলে ভারতকে এখন তড়িঘড়ি সে দেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের সেতুগুলো তৈরি করতে হচ্ছে। দিল্লি বোঝার চেষ্টা করছে, সেই সরকারে কাদের প্রভাব বেশি, এবং সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলোকে তারা আদৌ চেনেন কি না!
পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ আপাতত অন্ধকার, এটাও বোঝা যাচ্ছে দিব্বি। সে বাস্তবতা থেকেই বিকল্প কোন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে এবং সেটা কীভাবে – ভাবতে হচ্ছে তা নিয়েও।
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর সে দেশে জামায়াত বা হেফাজতে ইসলামের মতো ইসলামী শক্তিগুলোর দাপট ও রমরমাও ভারতের জন্য একটা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে।
তা ছাড়া গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে শত শত কোটি টাকা লগ্নি করেছে, এই সংকটের মুহূর্তে সে বিনিয়োগ কীভাবে আর কতটা রক্ষা করা সম্ভব – সেটাও ভারতের আর একটা বড় দুশ্চিন্তা!
এই ধরনের বহু প্রকল্পের কাজ এখন থমকে আছে। এবং সর্বোপরি ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’র মতো ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা আজ এক মাস হলো ভারতের মাটিতেই অবস্থান করছেন – কর্মকর্তারাই এখন একান্তে স্বীকার করছেন- নানা কারণে ভারত তাকে “না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে!”
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ঠিক এক মাস আগের নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক – দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিকেই ভারতকে এক অপ্রত্যাশিত সংকটে ফেলেছে। দিল্লি এই মুহূর্তে ঠিক কীভাবে সেগুলো সামলানোর চেষ্টা করছে – এই প্রতিবেদনে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে সেটাই!