সরকার পতনের পর নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে কর্মস্থল থেকে দূরে থাকা অধিকাংশ পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দিলেও এখনো কর্মস্থলে ফেরেননি আলোচিত কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। দেশের সব থানায় কার্যক্রম শুরু হলেও ডিবির সাবেক প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, পুলিশের প্রভাবশালী কর্মকর্তা প্রলয় জোয়াদ্দারসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এখনো কাজে যোগ দেননি। এখন তারা কোথাও আছেন সে বিষয়েও কেউ কোনো স্পষ্ট ধারণা দিতে পারছেন না।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। এর মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান হয়। সরকারের পতনের দিনই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থানা এবং পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সেদিনই সংঘর্ষে পুলিশসহ দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মধ্যে অনেক পুলিশ সদস্য থানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এর ফলে অনেকটা পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা।
পুলিশবিহীন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাতের বেলা টানা কয়েকদিন চলে ডাকাত আতঙ্ক। ডাকাত ঠেকাতে রাত জেগে রাস্তায় রাস্তায় পাহারা দেয় সাধারণ মানুষ। ওই পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দিতে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন কয়েকদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা সাখাওয়াত হোসেন।
গত ১১ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘পুলিশের যেসব সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, তাদের জন্য শেষ সময় হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবারের মধ্যে যদি কেউ যোগ না দেন, তাহলে ধরে নেওয়া হবে তারা চাকরিতে ইচ্ছুক নন।
কর্মস্থল ছেড়ে বাইরে অবস্থান করা পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দিতে আল্টিমেটাম দেওয়া হয় পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকেও। সেই নির্দেশনায় সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যে সিংহভাগ পুলিশ সদস্য যোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কর্মস্থলে ফেরেননি ডিবির সাবেক প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, প্রলয় জোয়াদ্দারসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এখনো যারা কর্মস্থলে ফেরেনি তাদের কাজে যোগ দিতে আরেক দফা সময় বাড়িয়েছে পুলিশ সদর দফতর। আগামী বৃহস্পতিবার পযর্ন্ত এই সময় বাড়নো হয়েছে বলে জানা গেছে।
কর্মস্থলে না ফেরা পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মাইনুল হকের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। এছাড়া ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার কয়েকজনকে কল করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।
তবে গণমাধ্যমে কথা বলার সময় পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র পুলিশ সুপার (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, নির্দেশনা মেনে বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যই কাজে যোগ দিয়েছেন। হয়তো অনেকে অসুস্থতাসহ নানা কারণে যোগ দিতে পারেননি।
ডিএমপিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএমপির ওসি, এসি ও এডিসি এবং ডিসিরা কাজে যোগ দিয়েছেন তারা নিয়মিত অফিসও করছেন। কিন্তু সাবেক ডিবি প্রধান (গত মাসে ডিএমপিতে বদলিকৃত) হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ও প্রলয় জোয়াদ্দার কাজে যোগ দেয়নি। তাদের কোনো খোঁজও মিলছে না। তারা সেনাবাহিনীর হেফাজতে আছেন নাকি গা ঢাকা দিয়েছেন তাও স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ। তবে সরকার পতনের কয়েকদিন পর কয়েকজন সাংবাদিক হারুনকে কল করলে তিনি ঢাকাতেই অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছিলেন।
ডিএমপি ও ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন পুলিশ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছিলেন হারুন। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও হয়েছেন। এমন অবস্থায় পরে পুলিশ সদর দফতর থেকে দেয়াল টপকে পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পান।
একটি সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট পুলিশের কন্ট্রোল রুম থেকে মাঠে থাকা পুলিশ সদস্যদের নানা দিক নির্দেশনা দেন হারুন। এমনকি গণভবনে ছাত্রদের মিছিল যাওয়ার সময়ও তিনি তাদেরকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে পরে পালিয়ে যান। পালানোর সময় পুলিশ সদস্যরা তাকে লাঞ্ছিত করে।
অন্যদিকে ডিএমপির আরেক প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকারও সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজে যোগ দেননি। তিনি এখন কোথায় আছেন তা জানা যায়নি।
২১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে চাকরি নেওয়া বিপ্লব সরকার ছিলেন ছাত্রলীগ জগন্নাথ হল শাখার সেক্রেটারি। পুলিশের চাকরিতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় পুরোটা সময় তিনি দাপুটে কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
বিশেষ করে ২০১১ সালে জাতীয় সংসদ এলাকায় তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে রাস্তায় পুলিশ দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন তিনি।
পুলিশের প্রভাবশালী এসপি হিসেবে খ্যাত প্রলয় জোয়াদ্দারও কাজে যোগ দেননি। তিনি যশোর ও নরসিংদীর এসপি ছিলেন। এই তিনজন ছাড়াও পুলিশ সদর দফতরের আতিকুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেনসহ কয়েকজনকে পুলিশ সদর দফতরে দেখা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এদিকে এসব কর্মকর্তা ছাড়াও যারা এখনো চাকরি হারাননি তারাও আতঙ্কে আছেন। অধিকাংশ কর্মকর্তা অফিসে এলেও তেমনটা বসছেন না। শুধু সাইন বা ফিঙ্গারিং দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
পুলিশের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যারা ‘দলবাজ কর্মকর্তা’ ছিল তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিচ্ছে সরকার। ফলে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরই মধ্যে এসবির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানকে চাকরিচ্যুত (বাধ্যতামূলক অবসর) করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে অবসর দেওয়া হতে পারে বলে গুঞ্জন আছে। এমন অবস্থান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আতঙ্কে আছেন।