কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে পড়ে সরকার থেকে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করতে হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এরপর থেকেই রাজবাড়ীতে লাপাত্তা মন্ত্রী, এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকসহ জেলার অনেক হাই প্রোফাইল আওয়ামী লীগ নেতা। এসব নেতারা এখন কোথায়, কিভাবে, কোন অবস্থানে রয়েছে তা জানে না জেলাবাসী।
জানা গেছে, রেলমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিল্লুল হাকিম গত ১১ জুলাই সরকারি সফরে ভিয়েতনাম ও জাপান ভ্রমণের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন। তিনি ১৪ জুলাই পর্যন্ত ভিয়েতনামে থাকেন। এরপর তিনি ১৫ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত জাপানে ছিলেন। জাপান সফর শেষে তিনি ২৫ জুলাই বাংলাদেশে আসেন। রেলমন্ত্রীর ভিয়েতনাম ও জাপান সফররত অবস্থায় দেশে কোটা আন্দোলন চলতে থাকে। সে সময় তিনি দেশে এসে রেলের ক্ষতি সম্পর্কে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন। কোটা আন্দোলনের সময় মন্ত্রী আর রাজবাড়ীতে আসেননি। সর্বশেষ তিনি ৫ জুলাই রাজবাড়ী এসেছিলেন। এরপর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। ওই সময় সারাদেশে বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়। তেমনি রাজবাড়ীতেও চলে তাণ্ডব। বিক্ষুব্ধ জনতারা পাংশা নারায়ণপুর এলাকার রেলমন্ত্রীর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে।
একটি সূত্রে জানা গেছে, রেলমন্ত্রী এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তবে তিনি ঢাকায় ন্যাম ভবনে আছেন নাকি অন্য কোথাও আছেন তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ হয়নি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম রাজবাড়ী-২ আসনের ৫ বারের সংসদ সদস্য। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। ক্লিন ইমেজ থাকায় তিনি এবারই প্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পান। তিনি রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রেলের ব্যাপক উন্নয়ন, টিকিট কালোবাজারি বন্ধ, ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি ছাড়া ঈদযাত্রা হয় না বলে নেতাকর্মীরা জানান।
এদিকে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাজী কেরামত আলী গত ৩১ জুলাই ঢাকা থেকে রাজবাড়ীতে আসেন। গত ৩১ জুলাই বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে কোটা বিরোধী ছাত্রদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। গত ৩ আগস্ট ৯ দফা দাবিতে রাজবাড়ী বিক্ষোভ মিছিল করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গত ৫ আগস্ট তিনি ও তার মেয়েসহ জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি কানিজ ফাতিমা চৈতী রাজবাড়ীতে অবস্থান করেন। ওইদিন বিকেলে রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন নেতাকর্মীরা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। ওই মিছিলটি পান্না চত্বর এলাকায় এলে যুবলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরের দিন ৪ আগস্ট রাজবাড়ীতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঠে নামতে দেয়নি সরকার দলীয় লোকজন। ওইদিনও সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী রাজবাড়ীতে নেতাকর্মীদের নিয়ে মিছিল করেন এবং শহরে অবস্থান নেন। ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত কাজী কেরামত আলী ও তার মেয়ে রাজবাড়ীতে অবস্থান করছিল। কিন্তু সরকার পতনের খবর শুনেই তারা জেলা শহর থেকে লাপাত্তা হয়ে যান। তারা কোথায় গেছেন এ বিষয়ে দলের কেউ জানেন না। তবে একটি বিশস্ত সূত্রে জানা গেছে, কাজী কেরামত আলী ভারতে চলে গেছেন।
অপরদিকে সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলীর ছোট ভাই কাজী ইরাদত আলী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি মেজো ভাই হিসেবে রাজবাড়ী শহরে পরিচিত। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই রাজবাড়ীতেই ছিলেন। অসুস্থ হওয়ার পর রাজনীতিতে তেমন একটা সক্রিয় না হলেও কোটা আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট ও ৫ আগস্ট তার নেতৃত্ব সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ। তিনি ৪ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে বড়পুল মোড়ে অবস্থান নেন এবং সবকিছু মনিটরিং করেন। পরের দিন ৫ আগস্ট তার নেতৃত্ব গোয়ালন্দ মোড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায় ছাত্রলীগ। ওই দিন দুপুরে সরকার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে তিনি বিকেলে বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে অবরুদ্ধ হন। বিক্ষুব্ধ জনতা তার গাড়ি ভাঙচুর করে ও তাকে মারপিট করে। তার সাথে থাকা পিএস রিংকুকেও মারধর করে বিক্ষুব্ধ জনতা। পরে স্থানীয়রা বিক্ষুব্ধ জনতাকে বুঝিয়ে কাজী ইরাদত আলীকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। পরে তারা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। বিক্ষুব্ধ জনতা কাজী ইরাদত আলীর বাড়ি লুটপাট করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া কাজী ইরাদত আলীর মালিকানাধীন জুট মিল অগ্নিসংযোগ, তেলের পাম্প ভাঙচুর করে।
এছাড়াও, রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফকরুজ্জামান মুকুট, সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল জব্বার, সহ-সভাপতি আকবর আলী মর্জি, সহ-সভাপতি হেদায়েত আলী সোহরাব, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি উজির আলী শেখ, সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সহ জেলার অন্যান্য নেতারা আত্মগোপন করেছেন।