ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বর্বরতা অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার রাতে মাত্র ২৫ মিনিটে উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় ১২২টি শক্তিশালী বোমা মেরেছে তারা। এতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বহু ভবন ও বাসাবাড়ি। গাজা শহরের সর্বত্র এখন ধ্বংসযজ্ঞ আর মৃত্যুর বিভীষিকা। ইসরাইলি আগ্রাসনে গেল ১০ দিনে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০ জনে, এরমধ্যে ৬৩ জনই শিশু। গাজায় এ পর্যন্ত ৫২ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৮শর বেশি ভবন-বাসাবাড়ি। ফিলিস্তিনিদের জন্য মানবিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের প্রধান অ্যান্তনিও গুতেরেস। আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে, গাজার ৫০টি স্কুল ধ্বংস করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে প্রায় ৪২ হাজার শিক্ষার্থীর স্কুলজীবন হুমকির মুখে পড়েছে।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশ্ব নেতাদের যুদ্ধবিরতির আহ্বান কানে তুলছে না ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। খবর বিবিসি, এএফপি ও আলজাজিরাসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের। মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে মাত্র ২৫ মিনিটে গাজা উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় ১২২টি শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করে ইসরাইলি বাহিনী। এ হামলায় অন্তত ৬০টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে তারা। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র হিদাই জিলম্যান প্রেস ব্রিফিংয়ে দাবি করে, মাত্র আধা ঘণ্টায় তারা ৬৫টি স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। হামাসের কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ ধ্বংস করেছে তারা। এ ভয়াবহ হামলার পর পাল্টা প্রতিরোধ হিসাবে ইসরাইলের ছয়টি বিমান ঘাঁটিতে হামলার দাবি করে ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। ঘাঁটিগুলো হলো- হাতসুর, হাতসারিম, নিফাতিম, তেল নুফ, বিলমাখিম ও র্যামন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ২২০ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি। নিহতদের মধ্যে ৬৩ জন শিশু ও ৩৭ জন নারী। ধ্বংস হয়েছে ৮শর বেশি ভবন ও বাড়িঘর। এতে ৭২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তবে জাতিসংঘের হিসাবে বাস্তুচ্যুত ৫২ হাজারের বেশি। ইসরাইলি হামলায় প্রায় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন দিন কাটছে গাজার ২০ লাখ অধিবাসীর।
হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে ঠিকঠাক চিকিৎসাসেবা দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। ভেঙে পড়েছে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। গাজার মেয়র ইয়াহিয়া আল-সারাজ বলেছেন, ইসরাইলি হামলায় উপত্যকার রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় জরুরি অনেক সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। জাতিসংঘ বলছে, গাজায় চরম পানি সংকটের কারণে অন্তত ৪ লাখ ৮০ হাজার মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। এক টুইট বার্তায় ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের প্রধান অ্যান্তনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক দুর্দশা এবং ঘর-বাড়ি ও অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখছি আমরা। এর আগে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক প্রধান মার্ক লোকক গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানান। এদিকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ জোরালো হচ্ছে। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, গাজায় সহিংসতা নিয়ে চতুর্থবারের মতো বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি হামলা কমানোর বিষয়ে কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
যুদ্ধবিরতির আহ্বানসংবলিত একটি খসড়া প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জমা দিয়েছে ফ্রান্স। মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে সমন্বয় করে ফ্রান্স এ উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে আজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সংঘাত থামাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যে সাধারণ পরিষদের এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানা যায়। এর আগে এ ইস্যুতে রোববার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির কারণে শুধু সংঘাত থামানোর আহ্বান জানানোর মাধ্যমেই বৈঠকটি শেষ হয়েছিল। তবে যুদ্ধবিরতির আহ্বানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরাইলিদের জন্য শান্তি পুনরুদ্ধার করতে যত দিন লাগে, তত দিন তাদের অভিযান চলবে। নেতানিয়াহুর ভাষ্য, গাজায় ইসরাইলের নয় দিনের বোমা হামলায় হামাসের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে তারা অনেক বছর পিছিয়ে গেছে। ইসরাইলের দাবি, গাজায় তাদের হামলায় কমপক্ষে ১৫০ ‘সন্ত্রাসী’ নিহত হয়েছে। অবশ্য ইসরাইলি হামলায় সংগঠনের সদস্যদের প্রাণহানির বিষয়ে হামাস কোনো তথ্য দেয়নি। এদিকে লেবানন থেকে ইসরাইলে চারটি রকেট হামলা হয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এর জবাবে লেবানন ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালায় তারা।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চায় সৌদি আরব : ফ্রান্সের একটি শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান বলেন, প্রথমে আমাদের এ সংঘাত থামানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। এরপর এ দুই অঞ্চলে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দুপক্ষের শান্তি আলোচনার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে এ নিয়ে চূড়ান্ত সমাধানের লক্ষ্যে ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসাবে দাঁড় করাতে হবে এবং এর রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। এ সংঘাত ধীরে ধীরে পরিস্থিতিকে উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে উল্লেখ করে ফারহান বলেন, এ দ্বন্দ্ব দুই অঞ্চলের মধ্যে টেকসই শান্তি আনার বদলে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে।
‘গাজায় ইসরাইলি বাহিনী ব্যর্থ’ : গাজায় ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ইসরাইলি সংবাদপত্র ‘হারেৎজ’। গত দুদিনে দৈনিকটির কয়েকটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইসরাইলি বাহিনীর সব কৌশল ব্যর্থ হয়েছে এবং ইসরাইলের জ্যেষ্ঠ কর্তারা যুদ্ধের ইতি টানতে চাচ্ছেন। মঙ্গলবারের এক নিবন্ধে পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক আলুফ বেন লিখেছেন, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর ব্যর্থতা ও পরাজয়ের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রয়োজন। গাজায় ভরাডুবির পর সামরিক বাহিনীতে সংস্কার আনা জরুরি হয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। হারেৎজ সম্পাদক আরও লিখেছেন, গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর সবচেয়ে বড় পরাজয় হয়েছে এবার এবং এ যুদ্ধের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। লেবাননের সঙ্গে দ্বিতীয় যুদ্ধ এবং গাজায় এর আগের যুদ্ধগুলোর চেয়ে এবারের যুদ্ধে পরাজয়ের স্বাদ বেশি তিক্ত।
যুদ্ধবিরতির আহ্বান ২৮ মার্কিন সিনেটরের : গাজায় চলমান হামলা বন্ধ করতে অতিসত্বর যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ জন সিনেটর। ডেমোক্র্যাট সিনেটর জন অসোফের নেতৃত্বে সোমবার সিনেটররা এক যৌথ বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান। নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে যৌথ বিবৃতি তুলে ধরেন সিনেটর জন অসোফ। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংঘাত যাতে আর না বাড়ে ও বেসামরিক মানুষের আর প্রাণহানি না ঘটে, এজন্য অতিসত্বর আমরা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছি।’