ছাগলের জন্য পেস্টেডেস পেটিস রুমিনান্টস (পিপিআর) ভ্যাকসিন ক্রয়ে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ বিষয়ে কমিটি মনে করছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পিপিআর রোগ নির্মূল ও ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে ব্যয় হওয়া প্রায় ৩০ কোটি টাকার বেশিরভাগই লোপাট হয়েছে। যে কারণে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
রোববার (১৪ জুলাই) জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ওই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সংসদীয় কমিটির সভাপতি শ. ম. রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকালে কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে কমিটির সদস্য বি. এম. কবিরুল হক, নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন ও মশিউর রহমান মোল্লা সজলকে সদস্য করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে বলে জানান ওই বৈঠকে উপস্থিত সংসদীয় কমিটির সদস্য মো. রশীদুজ্জামান।
তিনি বলেন, বৈঠকে অনির্ধারিত ওই বিষয়টি উত্থাপনের পর কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা সবাই সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে একমত হন। পরে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতার জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কমিটি সূত্র জানায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে দেশের ৬৪ জেলায় ছাগলের পিপিআর ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্ত ছিল যে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন দুইটি চুক্তিতে ৩০ কোটি টাকার কাজ এবং তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকের পছন্দের ঠিকাদারের অভিজ্ঞতা বা শর্ত পূরণের যোগ্যতা না থাকায় চারটি দরপত্র জমা হলেও তাদের নন-রেসপনসিভ করে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়, যা সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিক।
পুনরায় আহ্বানকৃত দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) তার নিজস্ব ঠিকাদার মেসার্স টেকনো ড্রাগস লিমিটেডের ইচ্ছা অনুযায়ী পূর্বের শর্ত বাদ দিয়ে নতুন শর্ত দেন শুধুমাত্র তার পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে। টেকনো ড্রাগসের ভেটেরিনারি পণ্য সরবরাহের অভিজ্ঞতা না থাকায় দরপত্র নীতি ভঙ্গ করে ফার্মাসিটিক্যাল আইটেমের (কনডম ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল) অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। প্রথম দরপত্রে দুই বছর ও ৩০ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও দ্বিতীয় দরপত্রে তা উল্লেখ করা হয়নি। কারণ টেকনো ড্রাগসের এই দুই অভিজ্ঞতার কোনোটাই নেই। দরপত্রের আরেকটি শর্ত ছিল যে, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বছরে ন্যূনতম চাহিদাকৃত ভ্যাকসিন উৎপাদনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু যোগানদাতা নেপালের হোস্টার কোম্পানির সেই সক্ষমতা ছিল না।
বিষয়টি জানার পরে পিডি কার্যাদেশ পত্রে দুই ধাপে দুই কোটি ৫০ লাখ করে মোট পাঁচ কোটি ভ্যাকসিন সরবরাহের কথা উল্লেখ করেন। দরপত্রে উল্লিখিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ভ্যাকসিনের গুণগত মান ও সক্ষমতা হোস্টার কোম্পানির ভ্যাকসিনে ছিল না। তবুও তাদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন ক্রয় করা হয়। আর সরবরাহকৃত ভ্যাকসিনটির গুণগত মান ও সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য পাবলিক হেলথ ও সিডিআইএল-এ পাঠানোর বিষয়টি দরপত্রে উল্লেখ থাকলেও শুধুমাত্র বিভাগীয় ল্যাবে নমুনা পাঠিয়ে নমুনা অনুমোদন করা হয়। ল্যাব টেস্ট করানোর আগেই টেকনো ড্রাগসের সরবরাহকৃত ভ্যাকসিন গ্রহণ করেই দ্রুত প্রথম ধাপের বিল পরিশোধ করেন।
সূত্র জানায়, গ্রহণকৃত ভ্যাকসিন যথাযথ মানসম্মত কি-না তা ছাগলের গায়ে পুশ করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পিডির অনুরোধে ডিজি এই বছরের ১৩ আগস্ট সাভার ছাগলের খামারের কর্মকর্তাকে চিঠি পাঠান। পরবর্তী সময়ে খামার কর্মকর্তা ২০ আগস্ট একটি প্রতিবেদন পাঠান। নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক টেস্টের প্রতিবেদন পাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধের নিয়ম থাকলেও প্রতিবেদন দেওয়ার এক মাস আগে ১২ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। আবার দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ভ্যাকসিনসমূহ যথাস্থানে পৌঁছানোর পর বিল পরিশোধের কথা থাকলেও তা অমান্য করা হয়।
উল্লেখ্য, ছাগলের পিপিআর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। রিন্ডারপেস্ট নামক এক ধরনের ভাইরাস ছাগল, ভেড়া, দুম্বাজাতীয় গৃহপালিত পশুকে আক্রমণ করে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ৭৫ শতাংশ ছাগলের মৃত্যু হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ‘পিপিআর রোগ নির্মূল ও খুরা রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প’র মাধ্যমে গৃহপালিত পশুর মৃত্যু প্রতিরোধে প্রতিবছর ভ্যাকসিন কিনে থাকে।
এদিকে, বৈঠকে কোটা পদ্ধতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি আদালতের বিবেচনাধীন থাকায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়াটি স্থগিত রাখার জন্য কমিটি কর্তৃক মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়।