রাজধানীর একটি বাড়িতে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে বন্দিদশায় নির্যাতন সহ্য করেছেন গৃহকর্মী রেখা আক্তার। দরিদ্র বাবা-মার সংসারের বোঝা কমাতে গৃহপরিচারিকার কাজ নেন তিনি। কিন্তু নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দীর্ঘ ১৩ বছর পর অবশেষে পালিয়ে এসেছেন রেখা আক্তার।
গত ২২ জুন মধ্যরাতে রেখা আক্তার নিজ বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের শিবগঞ্জ বাজার এলাকায় ফিরেছেন।
রেখা বলেন, তার বয়স যখন ১৩ বছর তখন অভাবের তাড়নায় পরিবার তাকে অন্যের বাড়িতে কাজের জন্য দিয়ে দেয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী ঢাকা প্রবাসী মহসিন আলী তাকে ঢাকার ভাড়া বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজের জন্য নিয়ে যান। সেখানে তিনি এক বছর কাজ করেন। কিন্তু তাদের নির্যাতন সইতে না পেরে কাউকে কিছু না জানিয়ে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যান।
রেখা আরও জানান, মহসিনের বাড়ি থেকে পালিয়ে কোনো এক মহিলার কাছে কাজের সন্ধান চাইলে তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সে বাড়িতে কাজ করা শুরু করেন রেখা। তিনি তখনও জানতেন না এ বাড়িতে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি। কাজে যোগ দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে নির্যাতন শুরু হয়। সেখানে এক প্রকার বন্দি করে ফেলা হয় তাকে। বাড়ি যাওয়ার কথা মুখে নিলেই ঘরের আসবাবপত্র, লোহার রড, কাঠ দিয়ে শুরু হতো মারধর।
রেখা বলেন, আমাকে বন্দি করে রাখা হতো। বাসার ময়লা ফেলতে গেলেও সে বাড়ির লোকজন আমাকে পাহারা দিত, যাতে আমি পালাতে না পারি। ভাবলেই বুক কাঁপে আমার। তারা আমাকে আমার বাড়িতে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে দেয়নি। আমাকে তালা দিয়ে রাখা হতো।
ঢাকার কোন এলাকায় ছিলেন জানতে চাইলে রেখা বলেন, আমি লেখাপড়া জানি না। শুধু জানি ঢাকায় প্রথম দিকে ভূতের গলি নামের একটি জায়গার আশপাশে ছিলাম। পরবর্তীতে যে বাসায় কাজ নিয়েছিলাম তার কোনো কিছুই আমি জানি না। ওই বাড়িতে ঢোকার পর আর বের হওয়ার বা কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশারও সুযোগ দেয়নি তারা। কষ্টের বিষয় এ ১৩ বছরে আমাকে কাজের কোনো মজুরি দেয়নি। এটুকু জানি সে বাড়ির মালিকের নাম ছিল মাহাবুব হোসেন ও তার স্ত্রীর নাম ঝর্ণা আক্তার। আমি সেখানে কাজ শুরুর কিছু দিনের মধ্যে মাহাবুব হোসেন আফগানিস্তান চলে যান। তার স্ত্রী আমার ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন।
কীভাবে পালিয়ে এলেন জানতে চাইলে রেখা বলেন, সেদিন বাসার শোকেসের ওপরে চাবি ছিল। আমি সেই চাবি দিয়ে বাড়ির সদর দরজা খুলে পালিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। এরপর এক বয়স্ক লোককে আমার ঘটনা শুনিয়েছি। তিনি আমাকে ৬০০ টাকা সাহায্য দিয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেন। তারপর বাসের কন্ডাক্টর আমাকে ঠাকুরগাঁও পৌঁছে দেন।
এদিকে রেখার মা আনোয়ারা বেগম মেয়ের ওপর অমানবিক নির্যাতনকারীর শাস্তি দাবি করে বলেন, যারা আমার মেয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে দীর্ঘ এক যুগ গৃহবন্দি রেখে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়নি, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে যেন দৃষ্টান্ত শাস্তি দেওয়া হয়। যেন আর কোনো মায়ের সন্তানের সঙ্গে এমন না করা হয়।
এ বিষয়ে মহসিন আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১১ সালে আমার স্ত্রী গর্ভবতী থাকার কারণে ঘরের কাজের সহযোগিতার জন্য রেখাকে গ্রাম থেকে এনেছিলাম। সে কাউকে কিছু না বলে বছর খানেক পর বাড়ি থেকে মালপত্র চুরি করে চলে যায়। এ ঘটনায় রেখার পরিবার আমাদের নামে অপহরণ মামলাও করেছিল। আদালত আমাদের খালাস দিয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে তৎকালীন চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে তার পরিবারের সঙ্গে আমরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমাধানও করেছি।
তবে রেখা চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বলেন, শুধু মহসীন আলীর নির্যাতনের কারণে তিনি ঘর ছেড়েছিলেন।
জামালপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, শুনেছি মেয়েটি বাসায় ফিরে এসেছে। মেয়েটি এর আগে একজনের বাসায় কাজে দেওয়া হয়েছিল। তার বাসা থেকে পালিয়ে যায়। তখন থানায় মামলা করা হয়েছিল। পরে এটা মীমাংসা করা হয়। এখন শুনতে পেরেছি অনেকদিন পর মেয়েটি আবার বাসায় ফিরে এসেছে।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর ইউএনও মো. বেলায়াত হোসেন বলেন, পরিবারটি যদি আইনগত সহায়তা চায় তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে আইনগত সহায়তা করা হবে এবং এর জন্য কোনো টাকা-পয়সা খরচ করতে হবে না।