কিশোরগঞ্জের ভৈরবে র্যাবের হেফাজতে সুরাইয়া খাতুন (৫২) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার (১৭ মে) সকালে মৃত অবস্থায় তাকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় র্যাব।
পুত্রবধূ হত্যা মামলার আসামি হিসেবে বৃহস্পতিবার (১৬ মে) রাতে উপজেলার নতুন বাজার এলাকা থেকে ওই নারী ও তার ছেলে তাইজুল ইসলাম মিলনকে আটক করা হয়। রাতেই ওই নারীকে র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পে আনা হয়। পরদিন শুক্রবার সকালে তাকে মৃত অবস্থায় ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় র্যাব। মৃত ওই নারী ময়মনসিংহের নান্দাইল থানার চন্ডিপাশা ইউনিয়নের বরুনাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা।
জরুরি বিভাগ থেকে জানা যায়, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়। এর ১২ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
আটকের পর ক্যাম্পের ভেতরে র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় সুরাইয়া কীভাবে মারা গেলেন সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেয়নি র্যাব। ভৈরব র্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার মো. ফাহিম ফয়সাল বলেন, ময়মনসিংহ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসবেন। তারা এ বিষয়ে ব্রিফ করবেন।
র্যাব হেফাজতে মারা যাওয়া সুরাইয়া খাতুনের স্বামী আজিজুল ইসলাম ফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পুত্রবধূ রেখা আক্তার ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তারপরও তার পরিবার মামলা করেছে। আর আমরা সেই মামলা আইনিভাবে মোকাবিলা করছি। কিন্তু গত শুক্রবার রাতে নান্দাইল থানায় পুলিশ আমাদের ডেকে এনে র্যাবের হাতে সুস্থ অবস্থায় আমার স্ত্রী ও ছেলেকে তুলে দিল। আসামিরা যদি থানায় আসে তাহলে পুলিশই গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু তাদের আটক করে র্যাব ভৈরব ক্যাম্পে নিল কেন? র্যাবের হেফাজতে রাতেই আমার স্ত্রী মারা গেছে। র্যাব নির্যাতন করে আমার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। আমি এর বিচার চাই।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নান্দাইল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাসান বলেন, হত্যা মামলা হওয়ার আগে ওই ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছিল। রেখার শ্বশুর আজিজুল মামলাটি করেছিলেন। মূলত অপমৃত্যুর মামলার তদন্তের প্রয়োজনে তাদের থানায় ডাকা হয়েছিল। তারা থানায় এসে পৌঁছাতে পারেননি। এর আগে শহরের নতুন বাজার এলাকা অতিক্রম করার সময় সুরাইয়া র্যাবের হাতে আটক হন। আজিজুল তাকে ফোন করে বিষয়টি জানান।
ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহমেদ বলেন, শুক্রবার সকাল ৭টায় র্যাব সদস্যরা সুরাইয়া খাতুন নামের এক নারীকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তাকে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক বিনিত দাস তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল।
কিশোরগঞ্জ জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জাহান বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সন্ধ্যা ৭টার দিকে র্যাব হেফাজতে থাকা নারী আসামি সুরাইয়া বেগমের মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসার পর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দেড় বছর আগে একই উপজেলার ভেড়ামারি গ্রামের কৃষক হাসিম উদ্দিনের মেয়ে রেখা আক্তারের সঙ্গে বরুনাকান্দি গ্রামের আজিজুল ইসলামের ছেলে তাইজুল ইসলাম লিমনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তার স্বামী তাইজুল ইসলাম দুই লাখ টাকা যৌতুকের জন্য রেখাকে চাপ দিতে থাকেন। এরপর অটোরিকশা কিনতে রেখার পরিবার তার স্বামীকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিলেও তিনি অটোরিকশা কেনেননি বলে রেখার পরিবারের অভিযোগ। পরে আরও একলাখ টাকা যৌতুক দাবি করলে টাকা দিতে অস্বীকার করেন তারা।
এর মধ্যে রেখা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল রাতে রেখাকে যৌতুকের টাকার জন্য তার স্বামী তাইজুল ইসলাম লিমন, শ্বশুর আজিজুল ইসলাম ও শাশুড়ি সুরাইয়া খাতুন অমানবিক নির্যাতন করেন। সেদিন রাতেই তাকে আহত অবস্থায় ইশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় তার স্বামী ও শাশুড়ি হাসপাতালে মরদেহ রেখে পালিয়ে যান। তবে শ্বশুর আজিজুল ইসলামকে হাসপাতালের কর্মচারীরা আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন।
সেদিন শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রচার করে রেখা ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু চিকিৎসক বলেন, তার গলায় ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে। খবর পেয়ে রেখার পরিবারের লোকজন মরদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে ময়নাতদন্তের পর দাফন করে। থানায় তারা মামলা করতে গেলে পুলিশ অপমৃত্যু মামলা হিসেবে নেয়। এরপর গত ২ মে রেখার মা রমিছা বেগম ময়মনসিংহের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তিনজনকে (স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ি) অভিযুক্ত করে একটি মামলা করেন। আদালতের বিচারক মামলার শুনানি শেষে নান্দাইল থানার ওসিকে মামলাটি এফআইআর হিসেবে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। গত ১৩ মে নান্দাইল থানায় মামলাটি রেকর্ড করা হয়। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন নান্দাইল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাসান।
এরই মধ্যে ভৈরব র্যাব ক্যাম্পের সদস্যরা বৃহস্পতিবার রাতে নান্দাইল থানায় গিয়ে পুলিশের মাধ্যমে স্বামী তাইজুল ইসলাম ও শ্বশুর আজিজুল ইসলামকে ডেকে আনে এবং শাশুড়ি সুরাইয়াকে বাজার থেকে আটক করে আনে। এ সময় শ্বশুরকে ছেড়ে দিয়ে দুজনকে আটক করে ভৈরব র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। শুক্রবার সকালে র্যাব মৃত অবস্থায় ভৈরবের হাসাপাতালে সুরাইয়াকে নিয়ে যায়। রেখার স্বামী তাইজুল ইসলাম এখনো র্যাবের হাতে আটক আছেন।