দ্বাদশ নির্বাচনের পর দেশের সংকট ‘আরও গভীর হয়েছে’ উল্লেখ করে তা নিরসন না হলে ‘সরকারের ভবিষ্যত খুব ভালো নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রোববার (১২ মে) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্য্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্তসমূহ এই সংবাদ তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একটা কথা আমি বলতে চাই, উনাদের (সরকার) একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ওভারকাম দ্যা ক্রাসিস… সংকট থেকে তারা উপরে উঠে গেছেন। আমি বলব, সংকট আরও গভীর করেছে। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংকট আরও গভীর হয়েছে, সরকারের সংকটও আরও গভীর হয়েছে।
সরকারকে সর্তক করে দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আপনারা যদি এখনো সেটা উপলব্ধি না করেন, সংকট নিরসনের চেষ্টা না করেন তাহলে ভবিষ্যত তাদের জন্য খুব ভালো না।
বিশ্ব মা দিবসের দিন বেগম খালেদা জিয়া কেমন আছেন জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বেগম খালেদা জিয়া শুধু বিএনপির মা নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মা। এজন্য যে, এই মহিয়সী নেত্রী তিনি সারাটা জীবনে এই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্য আমাদের এই মহিয়সী নেত্রীর তার সঠিক মূল্যায়নটা এদেশের অনেকে করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এখন লড়াই করছেন তার জীবনের। তার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনারা দেখছেন যে, প্রায়শ: তিনি যাচ্ছেন হাসপাতালে, তিনি চেকআপ, প্রসিজিউরও হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে, আবার বাসায় ফিরে আসছেন… আসার পরেও কিন্তু তিনি ২৪ ঘণ্টাই বলা যায় যে, তিনি মেডিকেল কেয়ারের মধ্যে আছেন।
‘ওরা লুটের বিশেষ গোত্র তৈরি করেছে’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখানে একটা গোত্র তৈরি করা হচ্ছে যাদেরকে সমস্ত রকম দুর্নীতি-অনিয়মের মধ্য দিয়ে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে… একটা লুটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটা দিয়ে তারা এই সরকারকে টিকিয়ে রাখছে… এর মধ্যে তারা নিজেরাও জড়িত এবং তাদের সুবিধাভোগী লোকজনরা জড়িত।
ফখরুল বলেন, আজকে যেগুলো দেখছেন সেগুলো হচ্ছে লুট…. মেগা লুট। একজন ব্যক্তি সে এখন সিঙ্গাপুরে গিয়ে হাইয়েস্ট ইনভেস্টার… চার নম্বরে আছেন… তাই না। আর কয়েকজন ব্যক্তি আছেন পানামা লিস্টের মধ্যে পড়ে যায়… এতো টাকা তারা বানিয়েছেন। এরা দুর্নীতি-অনিয়মের ওপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্রকে কি করে পরনির্ভরশীল করা যায় এবং তাদের বিশেষ গোত্রকে কিভাবে অন্যায়ভাবে আর্থিক দিক থেকে শক্তিশালী করা যায় সেই লক্ষ্যে তারা কাজ করছে।
তিনি বলেন, কারো কোনো জবাবদিহিতা নাই তো, কারো কোনো স্ট্যাক নাই তো। এখানে দেখেন একজন মন্ত্রীর যার লন্ডন বাড়ি পাওয়া আড়াই’শ-তিনশটার মতো, পত্রিকায় দেখা যায় যে, মন্ত্রী-এমপির বাড়ি-সম্পদ দেশের বাইরে রয়েছে… কারো কোনো স্ট্যাক নেই এখানে। তারা ডোন্ট কেয়ার। তাদের যে বক্তব্য, দাম্ভিকতা এটা অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে… এমনভাবে কথা বলেন যে, উনারা ছাড়া দেশে আর কেউ নাই। এটাতেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র অলিরেডি হয়েই গেছে। আমরা সেটা আগের থেকে বলে আছি যে, এই সরকার পরিকল্পিতভাবে এই রাষ্ট্রের পরিণত করেছে। কখন ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়? যখন অর্থনৈতিক, মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে, যখন তার রাজনৈতিক স্টাকচারটা ভেঙে ফেলে, সামাজিক কাঠামো ভেঙে যায় যখন কোথাও জবাবদিহিতা থাকে না তখন রাষ্ট্র একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়… নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এখন গোটা দেশে একটা নৈরাজ্য চলছে।
জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে দেশের অর্থনীতির ভিত্তির তৈরি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জিয়াউর রহমান একটা ক্লোজড ইকোনমি, একটা ফেল্ড পলিটিক্যাল স্টাকচার থেকে বেরিয়ে এনে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিলেন, মিক্সড অর্থনীতি এবং পরবর্তীকালে প্রাইভেট সেক্টর চালু করেছিলেন। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বেগম জিয়া তার শাসনামলে সেগুলো এগিয়ে নিয়ে গেছে। একটা বিষয় আপনাদের মনে থাকার কথা ২০০৬ সালের সময়ে নিউজ উইকের মতো পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছিল, বাংলাদেশ ইমার্জিং টাইগার…।
ফখরুল বলেন, এমনভাবে তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) কথা বলে যে, গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ে কোনো উন্নয়নই হয় নাই। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যে উন্নয়ন হয়েছে সেই উন্নয়নই অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করেছে। আজকে সেগুলো দেখছেন সেগুলো হচ্ছে লুট, মেগা লুট।
‘স্বাস্থ্য খাতের দুরাবস্থা অবিশ্বাস্য’
সরকারি হাসপাতালে অবস্থা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা কি সরকারি হাসপাতালে কেউ গেছে? যদি যান বিশেষ করে ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালে যান অবিশ্বাস্য… হাসপাতালে ঢুকা যায় না এতো দুর্গন্ধ, এতো নোংরা, দালালদের অত্যাচার চিন্তা করা যায় না।
তিনি বলেন, আর হাসপাতালের চারপাশে নতুন নতুন ডায়গোনেস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে…এটা বড় ব্যবসা। এখান থেকে দালালরা আসে সরকারি হাসপাতাল থেকে ধরে নিয়ে যায় রোগী… এই হচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয়করণে উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে কারণে ব্রেনডেইন হয়ে যাচ্ছে… যারা মেধাবী যারা নিজের যোগ্যতা আছে তারা দেশে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
বিচার ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করে সরকার মিথ্যা মামলায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দ্রুত সাজা প্রদানে যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা অবিলম্বে বন্ধের দাবিও জানান বিএনপি মহাসচিব।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশীয় বিষয়ক সহকারী সচিব ডোনাল্ড লু‘র ঢাকা সফর প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেখুন এসব আমাদেরকে জিজ্ঞাসা না করে উনাদের (আওয়ামী লীগ সরকার) জিজ্ঞাসা করুন। এসব নিয়ে আমরা ইন্টারেস্টেড না। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জনগণের ওপরই আমাদের ভরসা, আমাদের পুরো আস্থা, সেই আস্থার উপরে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। রাজনীতিও আমাদের জনগণকে নিয়ে।