আগুনে পোড়ানো হয়েছে ঘরবাড়ি। লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে মালামাল। খুলে নিয়ে গেছে ঘরের দেয়ালের ইট। গোয়াল, কবুতরের খাঁচা শূন্য পড়ে আছে। কেটে নিয়ে গেছে গাছপালা। জায়গায় জায়গায় পড়ে আছে ছাঁই।
দুই শতাধিক পরিবারের সাজানো সংসারের ধ্বংসাবশেষের এই চিত্র চোখে পড়ে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পেড়লি ইউনিয়নের পেড়লি গ্রামে। ধ্বংস হওয়া ওই বাড়িগুলোর সদস্যরা ভিটেমাটি ছেড়ে দীর্ঘ নয় মাস ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রতিপক্ষের ভয়ে নিজেদের ভিটেমাটিতে যেতে পারছেন না বলে অভিযোগ তাদের।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে জানান, পেড়লি গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুটি গ্রুপ রয়েছে। যার একটি বাবু শেখের গ্রুপ। অন্য গ্রুপটি শহিদুল মোল্যার । দুটি গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় নয় মাস আগে বাবু শেখ গ্রুপের আজাদ শেখ (৩০) দুর্বৃত্তদের হাতে হত্যার শিকার হন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের দলীয় প্রতিপক্ষের ২০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয় এবং দুই শতাধিক পরিবারের বাড়িঘরে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে তাদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে বারবার চেষ্টা করেও তারা আর নিজ গ্রামে ফিরতে পারেননি। ফলে ৯ মাস ধরে পালিয়ে পালিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
ভুক্তভোগী কউসার ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, নয় মাস আগে আমাদের এলাকায় একটা মার্ডার হয়ছিল। মার্ডারে হয়তো চার-পাঁচজন মানুষ ছিল। কিন্ত তারা (নিহত দলীয় লোক) এসে আমাদের প্রায় তিনশ লোকের বাড়িঘর পুড়ায়ে দিছে। লুটপাট করে নিয়ে গেছে। সেই রাতে আমরা কান্নাকাটি করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসছি। এ পর্যন্ত বাড়ি ওঠার সুযোগ দেয়নি। বাড়ির দিকে কেউ গেলে মারধর করতিছে। স্বজনদের মৃত্যুতে জানাজা পড়তে গেলেও মারধর করতেছে।
ভুক্তভোগী কিবরিয়া মোল্যা, আসাদ ভূঁইয়া আরও কয়েকজন বলেন, আমাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিছে। ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। সবকিছু লুটেপুটে নিয়ে গেছে। জায়গা-জমি দখল করে নিছে। আমরা সবাই গ্রামছাড়া। আজ এই আত্মীয়ের বাড়িতে কাল ওই আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে দিন পার করছি। আমাদের যে কি কষ্টে দিন যাচ্ছে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। এভাবে কতদিন চলব। পুলিশ সুপারে কাছে দাবি আমাদের বাড়িতে ওঠার ব্যবস্থা করে দিক। চালের তলে মাথা দিয়ে এক মুঠ লবণ ভাত যাতে খেতে পারি সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত পক্ষ। সকল অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে নিহত আজাদ শেখের বড় ভাই মো. উজ্জ্বল শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে আমরা তখন কাতর। তাদের ঘরবাড়ি পোড়াতে আমরা যায়নি। তাদের বাড়ি উঠতে না দেওয়ার কথাও মিথ্যা। আমার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তারা নিজেদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে নিজেরাই চলে গেছে এলাকা থেকে। আর যা কিছু করেছে এলাকার জনসাধারণ তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে করেছে। এর দায়ভার তো আমরা নেব না। তাদের ভিটা-বাড়ি আছে, তারা আসবে। তাতে আমাদের সমস্যা কি। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
এ সময় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে উজ্জ্বল বলেন, আমার এক চাচা যাচ্ছিল নড়াইলে। যাওয়ার পথে সিঙ্গের থেকে তাকে মারধর করছে। বাইরে যেতে গেলে আমাদেরই নিরাপত্তা নেই, তাদের আমরা কি ক্ষতি করব? আমরা যেদিকে যাব সেদিকে তারা বসে থাকে। কিছুদিন আগে আমাদের একটা ছেলেকে হত্যা চেষ্টা করেছে। আমরা ধৈর্য ধরে আছি। আইনকে শ্রদ্ধা-সম্মান করি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ভাই হত্যার সুবিচার চাই।
নড়াইলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মেহেদি হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজাদ হত্যার পর এজাহার নামীয় আসামিদের কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। আমরা চেষ্টা করছি মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার। নড়াইলের দীর্ঘদিনের একটি প্রথা হলো হত্যার পর আসামি পক্ষের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর হয়। আমি আসার পর বিভিন্ন স্থানে মিটিং করে স্থানীয়দের এগুলো থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আসছি। বিচার হবে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। তবে মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের। আমরা থাকতে কেউ নিজের বাড়িতে ঢুকতে পারবে না, এটা হতে পারে না। ইতোমধ্য উচ্ছেদ করা কিছু পরিবারকে বাড়িতে ওঠানো হয়েছে। বাকিদেরকে ১০ থেক ১৫ দিনের মধ্যে আমরা বাড়িতে ওঠানোর ব্যবস্থা করব।