বিশ্লেষকেরা একে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার লক্ষণ বলে মনে করছেন।ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বগির বিল এলাকায় ডাকাত সন্দেহে চারজনকে পিটিয়ে হত্যা করা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে। রোববার রাত একটার দিকে এলাকার লোকজন মাইকে ঘোষণার পর জড়ো হয়ে তাদের গণপিটুনিতে হত্যা করে। নিহতদের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত আছে। কিন্তু এত ঘটনার পরও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় বেশ পরে। ততক্ষণে লাশ সরিয়ে ফেলা হয়।
পুলিশ কখন আসে ঠিক নাই
সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) জাকির হোসেন জানান, আসলে আমাদের এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ ছিলেন। এই এলাকায় প্রায়ই চুরি ডাকাতি হয়। তাদের (নিহত) অতীত রেকর্ড ভাল না। তাদের এলাকার লোকজন চিনে ফেলায় মসজিদের মাইকে সবাইকে ডাকাত পড়েছে বলে আহ্বান জানালে লোকজন জড়ো হয়ে তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। ফোনে ফোনেও খবর দেয়া হয়। নিহতদের শরীরে ধারালো অস্ত্রেরও আঘাত আছে।
তিনজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আরেকজনকে হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যান। তারা ওই উপজেলারই বাসিন্দা। দুজনের লাশ পরিবারের সদস্য মঙ্গলবার নিয়ে গেছে। আর দুজনের লাশ এখনো হাসপাতালের মর্গে আছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলে পুলিশ জানায়।
ওই এলাকার বাসিন্দা এমদাদুল হক জানান, ঘটনার দুই দিন আগে শুক্রবার রাতে আমাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা আমার মায়ের গয়না এবং নগদ টাকা নিয়ে যায়। ডাকাতের আঘাতে আমরা বাবা গুরুতর আহত হন। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। ডাকাতের কারণে এলাকার লোক সতর্ক থাকেন। সন্দেহজনক এবং অপরিচিত কাউকে দেখলে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওই দিন তারা বিলের মধ্যে জড়ো হচ্ছিল বলে খবর পাওয়া যায়।। দুই-একজনকে আগেই এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
পুলিশকে খবর না দিয়ে কেন নিজেরাই মাইকে ঘোষণা দিয়ে ঘেরাও করল জানতে চাইলে ইউপি সদস্য জাকির হোসেন বলেন, পুলিশ কখন আসে না আসে তার ঠিক নাই। আগেও অভিযোগ দিয়ে কোনো কাজ হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ বিল্লাল হোসেন বলেন, যারা নিহত হয়েছেন তারা পেশাদার ডাকাত। তাদের নামে আগেও মামলা আছে।
তার কথা, ‘নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এবং আড়াইহাজার ডাকাতপ্রবণ এলকা। নদী, বিল ও দুর্গম এলাকা থাকায় ডাকাতরা সহজেই বিচরণ করতে পারে। ওইদিন তারা বিলের মধ্যে ডাকাতির জন্য জড়ো হচ্ছিল। এলাকার লোক টের পেয়ে তাদেও ঘেরাও করে গণপিটুনি দেয়।’ তবে তাদের কাছ থেকে পুলিশ কোনো ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি।
ইউপি সদস্য জাকির হোসেন জানান, ‘লাশগুলো দূরে দূরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ সারারাত তল্লাশি করে লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে। এলাকার মানুষ ডাকাতদের উৎপাতে অতিষ্ঠ থাকায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’
তবে শেখ বিল্লাল হোসেন দাবি করেন, ‘ওই এলাকা ডাকাতপ্রবণ হলেও আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক আছে। এলাকাটা থানা থেকে বেশ দূরে। তারপরও আমরা চেষ্টা করি পুলিশ টহলসহ নানা ব্যবস্থার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে।
বাড়ছে গণপিটুনিতে হত্যা
২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকার উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তসলিমা বেগম রেনু নামে এক মাকে। তিনি একটি স্কুলে গিয়েছিলেন তার সন্তানের ভর্তিও খোঁজ নিতে। এরপর সাধারণ মানুষ গণপিটুনির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলো। কিন্তু তারপর পরিস্থিতি আবার আগের মতো হয়ে গেছে। কোনো ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বড় করে প্রকাশ হলে তা নিয়ে আলোচনা হয়। আরও অনেক গণপিটুনির ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নাই।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে সারাদেশে গণপিটুনিতে নয় জন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। ২০২২ সালে ৩৬ জন। ২০২১ সালে ২৮ জন। ২০২০ সালে সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হন ৩৫ জন, ২০১৯ সালে সা ৬৫ জন৷ ওই বছর পদ্মা সেতুতে শিশুর রক্ত লাগবে, মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল৷ সেখান থেকেই ছেলেধরা গুজব তৈরি হয়৷ এরপর গত কয়েক বছরে এই ধরনের গুজব তৈরি না হলেও গণপিটুনি বন্ধ হয়নি৷ ২০১৯ সাল থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২২৪ জন।
সাড়ে চার বছরেও বিচার হয়নি রেনু হত্যার
রেনু হত্যাকাণ্ডের পর সাড়ে চার বছরের বেশি পার হয়ে গেলেও এখনো বিচার কাজ শেষ হয়নি। তার ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু জানান, এখনও সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ হয়নি। এই ঘটনায় ১৫ জন আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তাদের ১০ আদাললত থেকে জামিন পেয়ছেন। আর ৩৮ জন সাক্ষির মধ্যে এপর্যন্ত ১৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
এই ঘটনায় দুইটি আদালতে বিচার কাজ চলছে। আসামিদের দুইজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের বিচার চলছে নারী ও শিশু আদালতে।
নাসিরউদ্দিন টিটু বলেন, অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ায় এখন আর সাক্ষীদের আলাতে হাজির করা যাচ্ছে না। অনেকে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। আমি হতাশ। এই কারণে শেষ পর্যন্ত না মামলাটি আরো ঝুলে যায়।
তার কথা, এই ধরনের ঘটনার দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে গণপিটুনির ঘটনা অনেক কমে যেত।
কেন বাড়ছে গণপিটুনিতে হত্যা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, গণপিটুনির ঘটনার আমরা কোনো বিচার হতে দেখি না। ফলে গণপিটুনিতে হত্যা থামছে না। আর এই ধরনের মামলায় শত শত আসামি হওয়ায় পুলিশও কোনো দায়িত্ব নেয় না। এখানে সরকারের কোনো স্বার্থ নাই। সেটা থাকলে পুলিশ শত শত মানুষকে গ্রেফতার করত।
তার মতে গণপিটুনি কয়েক কারণে ঘটে। প্রথমত, মানুষ যখন বিচার পায় না, অপরাধের প্রতিকার পায় না তখন আইন হাতে তুলে নেয়। এরপর গোষ্ঠীগত স্বার্থে গুজব বা অপপ্রচারের মাধ্যমে গণপিটুনি হয়। আর কিছু লোক ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য গণপিটুনিকে ব্যবহার করে।
তার মতে তিনটি বিষয় দরকার, মানুষ যেন অপরাধের বিচার পায়। অপরাধী যাতে পার পেয়ে না যায়। তাহলে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবে না। আবার গণপিটুনিতে হত্যার মতো অপরাধ হলে তারও যেন বিচার হয়। এর বাইরে গুজব, অপপ্রচার এটা বন্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের এখানকার মানুষের মধ্যে মব সাইকোলজি আছে। তারা কারুর ছোটখাটো অপরাধে দলবদ্ধ হয়ে তাকে নির্যাতন বা গণপিটুনি দেয়। এর কারণ হতে পারে ওইসব অপরাধ বেড়ে যাওয়া, পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। তবে সংঘবদ্ধভাবেও এই গণপিটুনি হয় পরিকল্পনা করে, গুজব ছড়িয়ে। যেটা আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণের সময় দেখেছি। আবার গ্রামে মোড়লরা সালিশি করেও এই ঘটনা ঘটায়। তখন সেটা হয় নির্মম ও ভয়ঙ্কর।
তিনি মনে করেন, গণপিটুনি বন্ধে মানুষকে সচেতন ও মানবিক করে তুলতে হবে। আর কোনো অপরাধের সময় পুলিশ যদি ঠিক সময়ে সক্রিয় হলেও তা কাজে দেয়। তবে এত মানুষের দেশে সেটা কতটা সম্ভব সেটাই ভাবার বিষয়।
ফারুখ ফয়সালের মতে, গণপিটুনি বেড়ে যাওয়া খারাপ লক্ষণ । এতে বোঝা যায় মানুষ পুলিশ ও বিচারের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। আবার মানুষ মানুষের প্রতি অমানবিক হচ্ছে। সূত্র: ডয়চে ভেলে