ফলে প্রশ্ন উঠছে— সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মূল জাতীয় পার্টি আসলে কোনটি, দলীয় প্রতীক লাঙ্গল কি হাতছাড়া হচ্ছে জিএম কাদেরের?
মুজিবুল হক চুন্নু। জাতীয় পার্টির জিএম কাদের মহাসচিব তিনি। দলটির সিনিয়র এই নেতা বলেছেন, জাতীয় পার্টি ও লাঙ্গল নিয়ে সবকিছু নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। এখন অন্য কেউ গিয়ে বললেই তারা লাঙ্গলের মালিক হতে পারবে না।
তবে কেবল গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের নেতৃত্ব পরিবর্তন হলে নির্বাচন কমিশন দলীয় প্রতীক তাদের দিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। তিনি বলেন, শুধুমাত্র দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন করা হলে দলীয় প্রতীক তাদের দিতে পারবে নির্বাচন কমিশন। তা না হলে আদালতকেই এই সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
গত মাসে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থীরা দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয়। তবে বিষয়টি দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী না হওয়ায় ইসি তাদের আবেদন নামঞ্জুর করে।
জাতীয় পার্টির রওশন অংশের নতুন মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, রওশন এরশাদ যেখানে থাকবেন দলীয় প্রতীকও সেখানে থাকবে। হাইকোর্টের রায়ও আছে। এখন যদি আমরা লাঙ্গল নাও পাই পাঁচ বছর অপেক্ষা করব।
যেভাবে হলো রওশনপন্থীদের সম্মেলন
গেল শনিবার, অর্থাৎ ৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় রওশনপন্থীদের জাতীয় সম্মেলন। এতে যোগ দিতে সকাল থেকে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গার নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসেন। সম্মেলন উপলক্ষে মৎস্য ভবন মোড় থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটক পর্যন্ত ছিল রওশনপন্থীদের শোডাউন। তারা এরশাদ এবং রওশনের ছবি-সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে আসেন। তবে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হলেও আসেননি আওয়ামী লীগের কেউ।
যদিও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলামসহ কয়েকটি ছোট দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত কয়েকটি দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন ঘিরে নিরাপত্তা ব্যাপক জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দুপুর ১২টায় সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার সভাপতিত্বে কাউন্সিল শুরু হয়। এতে চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদের নাম প্রস্তাব করেন জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। একই সময় দলীয় মহাসচিব হিসেবে কাজী মামুনুর রশীদের নাম প্রস্তাব করেন গোলাম সারোয়ার মিলন। উপস্থিত কাউন্সিলর এবং ডেলিগেটরা এতে সমর্থন জানান।
এই সম্মেলনে নির্বাহী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি এর আগে জিএম কাদেরপন্থী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। এছাড়া নতুন এই কমিটিতে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান হয়েছেন সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, কো-চেয়ারম্যান হয়েছেন সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম, রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, গোলাম সারোয়ার মিলন ও সুনীল শুভ রায়।
জাপার রওশন অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশিদ বলেন, আমরা জিএম কাদের কিংবা চুন্নুদের দল থেকে বাদ দেইনি। তাদের উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হবে।
তবে সদ্য অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জাতীয় পার্টির ১৩ জন সংসদ সদস্যের কেউই অংশ নেননি। ছিলেন না সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ জিএম কাদেরপন্থী নেতাদেরও কেউ।
জিএম কাদের অংশের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এই সম্মেলনে যারা গেছে তারা সবাই দল থেকে বহিষ্কৃত ও অব্যাহতিপ্রাপ্ত। সক্রিয়ভাবে যারা জাতীয় পার্টি করে তাদের কেউ যায়নি।
বারবার ভাঙছে জাতীয় পার্টি
১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি গঠন করেন সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়া হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতনের পর আর ক্ষমতায় যেতে পারেনি দলটি। তবে বেশ কয়েকবার ভাঙনের মুখোমুখি হতে হয়েছে দলটিকে।
সর্বশেষ চলতি বছর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সরকারের সাথে সমঝোতার পরও দলটি মাত্র ১১টি আসনে জয়লাভ করে। এতে দলের অনেক সিনিয়র নেতা মনোনয়ন-বঞ্চিত হন। কেউ কেউ আবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েও পরাজিত হন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। এরপরই দলের মধ্যে সংকট তৈরি হয়। গত ২৮ জানুয়ারি জিএম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন এরশাদ পত্নী বেগম রওশন এরশাদ। গত শনিবার (৯ মার্চ) সম্মেলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয় ওই কমিটি।
তবে ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েন তৈরি হলেও এতটা সংকটে পড়তে হয়নি দলটিকে।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের আগেই প্রথমবার ভাঙে জাতীয় পার্টি। তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা টের পেয়ে জাতীয় পার্টির প্রথম মহাসচিব ডা. এম এ মতিনসহ বেশ কয়েকজন দল থেকে বেরিয়ে যান। যদিও তার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (প্রতীক কাঁঠাল) গঠিত হয় অনেক পরে।
১৯৯৬ সালে আবারও ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। তখন এরশাদ বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দিলে তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জাতীয় পার্টি থেকে সরে গিয়ে নতুন দল গঠন করেন। সেই দলের নাম হয় জাতীয় পার্টি-জেপি।
১৯৯৯ সালে এরশাদের জাতীয় পার্টি চারদলীয় জোট ছেড়ে দিলে তখনকার মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু এরশাদের জাতীয় পার্টি ছেড়ে নতুন দল গঠন করেন। তার দলের নাম হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি।
২০১৪ সালে দশম জাতীয় নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলে সাবেক মহাসচিব কাজী জাফর আহমেদ আলাদা দল গঠন করে বিএনপি জোটে থেকে যান। এই দলটির নাম হয় জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)।
নতুন করে দলের ঘোষণা দেওয়ার পর রওশন অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশিদ বলেন, জিএম কাদের ও চুন্নু জাতীয় পার্টিকে চরমভাবে ধ্বংস করেছে। রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন এই সম্মেলনের মাধ্যমে।
লাঙ্গল নিয়ে টানাটানি
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায় প্রায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে দলে সংকট তৈরি হয়েছে। ভেঙেছেও বেশ কয়েকবার। এখন নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পার্টির বিভিন্ন অংশের নামে চারটি দল নিবন্ধিত রয়েছে।
২০১৯ সালের এরশাদের মৃত্যুর আগে জাতীয় পার্টি বারবার ভাঙলেও লাঙ্গলের নিয়ন্ত্রণ ছিল এরশাদের হাতেই। তবে এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টিতে জিএম কাদের ও রওশনপন্থীদের মধ্যে টানাপোড়েন চলছেই।
জিএম কাদেরের হাতে দলীয় নেতৃত্ব থাকলেও গত চার বছরে বেশকিছু নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিলেন এরশাদ পত্নী রওশন এরশাদ। কিন্তু তা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী না হওয়ায় সে সব মনোনয়ন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে দলের ভরাডুবির পর রওশনপন্থীরা চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশনে। পরে নির্বাচন কমিশন তাদের চিঠি দিয়ে জানায়, তাদের অপসারণ প্রক্রিয়া গঠনতন্ত্র অনুযায়ী না হওয়ায় ওই আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে। গত শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন করে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন রওশনপন্থীরা। নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে রওশন এরশাদ দাবি করেন দলীয় প্রতীক লাঙ্গল তার।
শনিবার রওশন এরশাদ বক্তৃতায় বলেন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর লাঙ্গল প্রতীক ধরে রাখতে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছিল। সুপ্রিমকোর্ট সেই সময় এরশাদ ও আমাকে লাঙ্গল প্রতীক দিয়েছিলেন। এখনও লাঙ্গল জাতীয় পার্টির আছে, আগামীতেও থাকবে।
তবে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আগে ভাঙার পর যা হয়েছে, এবারো নতুন কিছু হবে না। যারা দল নিয়ে এগুলো করছে তারা হয়তো আমাদের চাপে ফেলার জন্য করতে পারে। আমরা দলীয়ভাবে সব নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী মনোনয়ন দেই। সামনেও দেবো।
জাতীয় পার্টির জিএম কাদের অংশ বলছে— দলের মূল অংশ হিসেবে তারাই নির্বাচন কমিশনের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। সেসব তথ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্য ভাণ্ডারে আছে। তাদের বক্তব্য, চাইলেই কেউ নির্বাচন কশিনের নিয়ম ভাঙতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, দলীয় প্রতীক বরাদ্দ কিংবা যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে গঠনতন্ত্রে যে কয়জন প্রেসিডিয়াম মেম্বারের সাপোর্ট লাগে সেই অনুযায়ী যদি রওশনপন্থীরা তথ্য জমা দেন তাহলে নির্বাচন কমিশন তার আইন অনুযায়ী বিবেচনা করবে।