১৫ ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৩ দিবাগত রাতে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ঝাপিয়ে পরে আমাদেরি মিলিটারি।। ৮৩, ১৬ই ফেব্রু, এর আজ সকালে, হলের বাথরুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সুধুই মেলিটারি। হলটা ঘিরে আছে। দৌড়ে নিচে চলে এলাম। হলের গেট বন্ধ করে তালা লাগানো হলো। তার পর ফোন করা হল, প্রভোষ্ট স্যারকে। তিনিও বললেন তার বাসাও মিলিটারিরা ঘিরে আছে। ভি সি স্যারকে ফোন করা হলো। তখন
ভি সি ছিলেন, প্রোফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তিনিও গৃহ বন্দী। বললেন শিক্ষক ছাড়া হলের গেট না খুলতে। ওরা যদি তালা ভেংগে ঢোকে, তবে তাই করুক। তোমরা তালা খুলবো না। সবাইকে শান্ত থাকতে বলো। হয়তো আমার সাথে তোমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এখন ওদের দখলে। তবে তোমরা কোন বৃশ্খলতা করবে না।
মিলিটারিরা এসে কলাপসিবল গেট খোলার জন্য বার বার ধাক্কাতে থাকলো। আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম হলের প্রোভোষ্ট ছাড়া গেট খুলবো না। ইতিমধ্যে ফোন লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। যোগাযোগ সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন। বেশ খানিক পর প্রোভোষ্ট, গনিতের সামসুর রহমান স্যার কয়েকজন হাউস টিউটর নিয়ে মিলিটারিদের সাথে গেটে আসলেন। আমরা তালা খুলে দিলাম।
হলে ঢুকেই হৈচৈ সুরু করলো। সে কি তর্জন গর্জন ! সবাইকে রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে আসতে বললো। তারপর, লাইন করে, সবাইকে ফুটবল মাঠে নিয়ে যাওয়া হল।
এম এইচ হলের সবাই আমরা, আমাদের খেলার মাঠে, আমাদের জরো করা হলো। বর্তমান উম্মুক্ত মন্চের উপরের মাঠে। সবাইকে লাঔন করে বসানো হলো। লম্বা লাইন। চারিদিকে সশস্ত্র পাহারা। মনে হলো একটা যুদ্ধ । ট্যাংক ছাড়া সব রকমের অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘিরে রেখেছেন। পজিশন নিয়ে, চারিদিকে শুয়ে- বসে -দাড়িয়ে আমাদের উপর নজর রাখছেন। আমার ১৬ ই ডিসেম্বরের সরওয়ার্দী উদ্যানের কথা মনে হলো ! মনে হলো, আমরা যেন কোন এক ভিনদেশী বন্দী সেনা, যুদ্ধে হেরে যাওয়া কোন জনপথ !
সবার সামনে দাড়িয়ে এবার শুরু হলো আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে, মেলিটারী বয়ান, বক্তৃতা! আমরা ছাত্র, আমাদের উদ্দেশ্য কি, আমাদেরকে পড়াতে যেয়ে দেশের কত ত্যাগ করতে হচ্ছে। তাই দেশের প্রতি আমাদের কত দায়িত্ব থাকা প্রয়োজন, ইত্যাদি।
প্রচন্ড সূর্যের তাপ। সামনের দেকে তাকিয়ে থাকা কষ্টকর। উনি জানালেন, পৃথিবীর বহুদেশে, মেয়েরা তামাটে ছেলেদের পছন্দ করেন। তাই সূর্যের দিকে তাকিয়েই থাকা চাই। তা-হলেই দেশের লাভ। সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার নির্দেশ দিয়ে, কত কুরুচি পু্র্ন ইংগিত করছিল! বিস্রি ! রোদে পুরলে তামাটে বর্ন হবে। কোন কোন দেশের মেয়েরা তামাটে বর্নের ছেলেদের পছন্দ করে, তার ফিরিস্তি দিলো, কুতসিত ভাবে।
এরপর দুপুরের পর সবাইকে হলে যেয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাগ ও ID নিয়ে হলের বাইরে জরো হতে বলে। আমরা ভাবলাম, এবার হয়তো মুক্তি মিলবে।তাই সবাই তারাতাড়ি করে, রুমে যেয়ে,যার যার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে চলে আসছিলো।
আমিও ব্যাগ’টা ঘারে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়েছি, অমনি তিনজন সাদা পোষাকের মিলিটারি গোয়েন্দা এগিয়ে এসে, আমাকে বললো, আপনার নাম কি হারুন ? আমি বললাম, সদরুল আলম। ওনারা আবার বললেন, হারুন? বললাম, সদরুল আলম। বললো, সদরুল আলম হারুন ? ওরা ওদের হাতের ফাইল দেখে দেখে প্রশ্ন করছিল।হাল ছেরে দিলাম। বললাম, হ্যাঁ, আমার নাম সদরুল আলম ।।
বললো, আমাদের সাথে আসুন। কোন উচ্চ বাচ্চ করবেন না। আপনাকে ক্যান্টনমেন্ট যেতে হবে। বলে হাটতে শুরু করলো।। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। পুরো হল মিলিটারিরা ঘিরে রেখে, হলের ভিতরে সেন্ট্রি, এখন কি করা উচিৎ !? ভাবছিলাম, একজন ধমক দিয়ে বললো, চলুন । ধীরে ধীরে হাটা শুরু করলাম। ভাবলাম, ভাগ্গিস রুম’টা সার্স করলো না।
মাঠের ভিতর মাজখানে, যেখাবে ক্রিকেট এর নেট প্রাক্টিস হয় সেখানে, নেট দিয়ে ঘেড়া যায়গাটায় নিয়ে আমাকে একা বসিয়ে রাখলো। একা! ভয় করছিল। কান্না পাছ্চিল। আমাকেই এরেস্ট করলো? সুধুই আমাকে? তখন এক মিলিটারি বলছিলো, ইন্ডিয়ান স্পাই ধরছি। ভাবলাম এরা কারা। জিজ্ঞেস করতেই বললো, দেখতেই পারবেন। সন্ধায় ট্রাকে তোলার সময় দেখলাম, আমার আরো অনেক সাথি আছে। ট্রাক ছুটছে সাভার ক্যান্টনমেন্টের দিকে।
ট্রাক ধীরে ধীরে এগিয়ে যাছ্চিল, আমরাও এক ভয়ের রাজ্যের দিকে এগোছ্চিলাম। একসময় ট্রাক থামলো মিলিটারিদের কোয়াটার গার্ড এর সামনে। নামতেই দেখতে পেলাম, আমার দেশের দেশপ্রেমিক মিলিটারি কি কুৎসিত ভাবে কথা বলতে ও আচরন করত পারে। সবাইকে লাইন করে দাড়াতে বললো। তারপর এক এক করে ব্যাগ সহ এগিয়ে একটা রুমের ভিতর যেতে বললো। যখনই কেউ ঘরে ঠুকতে যাব, অমনি পাকি কায়দায়, পাছায় বুট দিয়ে লাথ্থি, আর পিস্তলের বাট দিয়ে মাথার পিছনে আঘাত ! সাব্বাশ। আমার টাকায় কেনা অস্ত্রের আঘাতে…….
ভিতরে ঢোকানোর পর ঘরে দারানোর মত জায়গা নাই। ১৫ ফুট বাই ১৫ ফুট ঘরে প্রয় ৫০ জন তথাকথিত দুষ্কৃতিকারী !
লেখক : সদরুল আলম হারুন, কলামিস্ট
(চলবে)