নতুন শুল্কায়ন পদ্ধতিতে প্রতি কেজি চিনিতে আমদানি শুল্ক কমেছে ৬৮ পয়সার মতো। যা বাজারে প্রভাব পড়ার মতো নয় উল্লেখ করে ব্যবসায়ীরা বলছেন— তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেনি আমদানি শুল্ক। ফলে শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও বাজারে এর প্রভাব পড়ার মতো নয়।
ভোক্তাদের অভিযোগ— আমদানি শুল্ক কমানোর ঘোষণায় দাম কমবে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। উল্টো দাম আগের চাইতে বেড়েছে। বিশেষ করে গত কয়েকদিন দফায় দফায় খেজুর-চিনির দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। দেখার যেন কেউ নেই।
ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা পর্যন্ত। প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। কোথাও কোথাও ছাড়িয়ে গেছে এই দামও।
কারওয়ান বাজারের পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সপ্তাহের শেষের দিকে মানভেদে প্রতি বস্তা খোলা চিনি (৫০ কেজি) বিক্রি করেছেন ৬ হাজার ৬০০ থেকে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা পর্যন্ত। শনিবার সেই চিনি বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৮০০ টাকায়। অর্থাৎ দুদিনের ব্যবধানে পাইকারিতে কেজিপ্রতি চিনির দাম বেড়েছে ৪ টাকা পর্যন্ত। যার প্রভাব প্রড়েছে খুচরা বাজারেও।
যদিও কিছুদিন আগে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেছিলেন, রোজার সময় কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন অনেকেই সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেন। আমদানি ও বাজারজাতকারীরা যত বড় ব্যবসায়ী হোক না কেন, অযথা পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু কোনো কাজে আসেনি প্রতিমন্ত্রীর সেই হুঁশিয়ারি। সভা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর নিজেদের উৎপাদিত চিনির কেজিতে ২০ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। যদিও ঘোষণার পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে তা প্রত্যাহার করে নেয় সংস্থাটির নিয়ন্ত্রক শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে অস্থিরতা তৈরি হয় চিনির বাজারে। সঙ্গে সঙ্গেই পাইকারি ও খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যায়। দু’দিন আগের ঘোষণাটি কার্যকর না হলেও কিছু ব্যবসায়ী ১৬০ টাকা দরে প্যাকেট চিনি বিক্রি শুরু করেন।
বাংলাদেশ পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি আবুল হাশেম বলেন, চিনিকল করপোরেশনের দাম বাড়ানোর ওই ঘোষণা বাজারে বেশ প্রভাব ফেলছে। মিলাররাও নড়েচড়ে বসেছিল। ওই রাতে পাইকারিতে প্রতি মণে ৪০-৫০ টাকা বেড়েছিল। গতকাল তা আবার কমে গেছে। খুচরা পর্যায়েও কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, চিনির শুল্ক কমেছে ৫০ পয়সার মতো। এতে বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। কেজিপ্রতি অন্তত ৫ টাকা শুল্ক কমলে বাজারে প্রভাব দেখা যেত। এছাড়া প্রতিবেশী দেশে চিনির দাম কম থাকায় অবৈধভাবে অনেক চিনি দেশে ঢুকেছে।
অপর দিকে রাজধানীর বাজারগুলোতে দফায় দফায় বাড়ছে খেজুরের দাম। আমদানি শুল্ক কমানো পণ্যটি গতকাল কেজিপ্রতি (মানভেদে) বিক্রি হয়েছে, ২৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। এক মাসের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত।
জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় (মানভেদে) কেজিপ্রতি খেজুরের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে বাজারে যেসব খেজুর পাওয়া যায় তার মধ্যে সাধারণ মানের খেজুর ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা, দাবাস খেজুর ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, ভালো মানের মরিয়ম খেজুর ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, মাবরুম খেজুর ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, আজওয়া খেজুর (মানভেদে) ৮০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা, সুফরি মরিয়ম ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, আম্বার ও সাফাভি ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা ও সুক্কারি খেজুর ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে মানভেদে এসব খেজুরের দাম কোথাও কোথাও আরও বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে প্যাকিংভেদে প্রতি টন খেজুরের শুল্কায়ন মূল্য ছিল ৫০০ থেকে ১ হাজার ডলার, কিন্তু বর্তমানে শুল্কায়ন মূল্য বেড়ে হয়েছে প্রতি টন ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৭৫০ ডলার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ ও ভ্যাট ১৫ শতাংশ।
খেজুর আমদানিকারকরা জানিয়েছেন— খেজুর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে আগে সব মিলিয়ে ১৬৪ টাকা কর বাবদ দিতে হতো। এখন তা ৩৩ টাকা কমবে। আমদানিকারকরা জানান, গত বছর রোজার আগে খেজুর আমদানিতে করভার ছিল ১০ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে খেজুরকে লাক্সারি পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। খেজুর আমদানিতে করভার ও শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দুবাই, আরব আমিরাত, ইরাক থেকে যে খেজুর আমদানি করছি তার দাম পড়ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া ডলারের দামও বেড়েছে। তিনি বলেন, খেজুরের এলসি যে মূল্যে খুলছি সে অনুযায়ী শুল্ক নির্ধারণ হলে খেজুরের দাম কম পড়ত। কিন্তু বিলাসি পণ্যের তালিকায় খেজুরকে অন্তর্ভুক্ত করায় বাড়তি শুল্ক দিতে হচ্ছে। ফলে খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমানো হলেও দেশের বাজারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আসন্ন রমজানে চিনি, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে আমদানি শুল্ক কমিয়েছে সরকার। কিন্তু এর প্রভাব বাজারে পড়েনি। উলটো পণ্যগুলোর দাম আরও বাড়ছে। এ ব্যাপারে বাজারে অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে ব্যবস্থা নিতে হবে।