চলতি মাসে (ফ্রেব্রুয়ারি) পিসিএ চুক্তির খসড়া ঢাকার কাছে পাঠানোর কথা রয়েছে ব্রাসেলসের। পিসিএ চুক্তি সইয়ের আগে খসড়া নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে বছরজুড়ে সিরিজ বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে মার্চে ব্রাসেলসে চুক্তির এই খসড়া নিয়ে প্রথম বৈঠকের কথা রয়েছে।
ঢাকা ও ব্রাসেলসের কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, অতীতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন কিংবা নির্বাচন নিয়ে ইইউর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কিছুটা অস্বস্তি ছিল। ঢাকার কূটনৈতিক তৎপরতায় সেই অস্বস্তি কেটে গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের সরব অবস্থানের জানান দিলেও শেষ মুহূর্তে একেবারে নীরব ছিল। শুধু তাই নয়, নির্বাচন পরবর্তী বিবৃতিতে বড় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না আসায় দুঃখ বা হতাশা প্রকাশ করলেও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। বরং নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার বার্তা বিবৃতিতে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে ইইউ।
ব্রাসেলসের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, চলতি মাসে পিসিএ চুক্তির খসড়া ঢাকার কাছে পাঠানোর কথা রয়েছে। পিসিএ চুক্তি সইয়ের আগে খসড়া নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে চলমান বছরজুড়ে আলোচনা হবে। আগামী মার্চে ব্রাসেলসে এই খসড়া নিয়ে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকেও ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পাওলা পামপালোনি নেতৃত্ব দেবেন। পরের বৈঠকটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। চলমান আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পিসিএ চুক্তির আগে খসড়াটি নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে বছরজুড়ে কমপক্ষে পাঁচটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. হাছান মাহমুদকে। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে গত ১৭ জানুয়ারি সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে পিসিএ চুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন রাষ্ট্রদূত।
রাষ্ট্রদূত হোয়াইলি বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে আমাদের (ঢাকা-ইইউর) সম্পর্কের ধাপ পরিবর্তন হতে দেখব, যেটি চালিত হবে নতুন অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির আলোকে। এবারের অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তিতে সম্পর্কের ধরন হবে ২০০১ সালে হওয়া চুক্তির তুলনায় অনেক বেশি রাজনৈতিক। যেখানে ২০০১ সালের চুক্তি অনুযায়ী সম্পর্ক ছিল মূলত উন্নয়ন ও সহযোগিতাকেন্দ্রিক।’
ঢাকার এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, ২০০১ সালে ইইউর সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি করে বাংলাদেশ। সেই চুক্তিতে অর্থনীতি, উন্নয়ন, সুশাসন কিংবা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। সময়ের ব্যবধানে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের সক্ষমতা বেড়েছে। অবস্থান আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। সবাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চায়, আগ্রহ প্রকাশ করছে। ইইউ এবং বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরে পা দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ইইউ ভালো সম্পর্ক উপভোগ করছে। তারা ভূ-রাজনীতি, নিরাপত্তা ইস্যু তথা ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো বিষয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চায়। বাংলাদেশও ইইউর সঙ্গে সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে নিতে আগ্রহী।
জ্যৈষ্ঠ এ কূটনীতিক আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫-২৬ অক্টোবর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশন আয়োজিত প্রথম গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে যোগ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্রাসেলস সফর বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হওয়া দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই শীর্ষ নেতা যৌথ বিবৃতি দেন।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট তার বিবৃতিতে বলেছিলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আমরা একটি দৃঢ় অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছি এবং এখন আমরা এটিকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাচ্ছি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে উভয়পক্ষ সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে নিতে আলাপ-আলোচনা করছে। অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে উভয়পক্ষ কাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইইউ বাংলাদেশের জন্য খুব গুরত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও ইইউর বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারাটা আমাদের জন্য খুব জরুরি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইইউর এখানে আগ্রহের যথেষ্ট কারণ আছে। তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ দুই ইস্যুতে জোটের কিছু সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে কিছু টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু সেটা কূটনৈতিক তৎপরতায় বা যে কোনো উপায়ে সরকার ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছে। সামগ্রিক বিবেচনায় জরুরি হচ্ছে, বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক অংশীদারিত্ব পর্যায়ে উন্নীত করা।’
গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পাওলা পামপালোনি একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ঢাকা সফর করেন। ওই সফরে পামপালোনি পররাষ্ট্র-বাণিজ্য ও শ্রম সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠকে এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও ইইউর বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি প্লাস সুবিধার পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ইইউকে জানায়— স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর যদি তৈরি পোশাক খাতের পণ্য তাদের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার বাইরে থাকে তবে তা হবে অর্থহীন। তৈরি পোশাক খাতকেও শুল্কমুক্ত সুবিধার মধ্যে (জিএসপি প্লাস) যুক্ত করতে হবে।
এছাড়া শ্রম ইস্যুতে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার যে নয়টি টার্গেট আছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। ইইউকে ঢাকার পক্ষ থেকে জানানো হয়— কর্মপরিকল্পনার প্রায় ৮০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। ইইউ প্রতিনিধিদল ইইউ লেবার ল’ ডেপ্লয়মেন্ট প্রসঙ্গ তোলে। ঢাকার পক্ষ থেকে ইইউকে জানানো হয়— এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৪ নভেম্বর ঢাকায় প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক সংলাপ করে বাংলাদেশ-ইইউ। ওই সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। অন্যদিকে ইইউর পক্ষে ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এনরিকে মোরা নেতৃত্ব দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে— ২০২২ সালের অক্টোবরের শেষ প্রান্তে ব্রাসেলসে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে ইইউর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এনরিকে মোরার বৈঠক হয়। সেসময় রাজনৈতিক সংলাপের সিদ্ধান্ত হয়। পরে গত বছরের ২৮ জুন ঢাকায় সংলাপের তারিখ চূড়ান্ত হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ইইউর কারণে সংলাপটি হয়নি। পরে সেটি গত বছরের ২৪ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া গত বছরের মে’র মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ ও ইইউর যৌথ কমিশনের দশম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।