তারা ধুনট নবির উদ্দিন পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন।
জানা যায়, স্কুলশিক্ষক গোলাম মোস্তফার স্ত্রী আর্জিনা বেগম ২০০৪ সালের ১০ জানুয়ারি একই সঙ্গে তিন ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। এর আগে তাদের ঘরে জন্ম নেয় এক ছেলে এবং এক মেয়ে। ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর মারা যান গোলাম মোস্তফা। তখন এই তিন যমজ সহোদরের বয়স মাত্র ৫ বছর। স্কুলশিক্ষক বাবাকে হারানোর পর শুরু হয় তাদের শিক্ষা জীবন। গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। পরবর্তী সময়ে ধুনট সরকারি নইম উদ্দিন পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন শেষ করেন তারা। চলতি বছরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিন যমজ ভাই ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। বাবাহারা এই তিন যমজের পুরো শিক্ষা জীবনে আলো-ছায়া হয়ে সঙ্গে ছিলেন গৃহিনী মা আর্জিনা বেগম।
স্কুলশিক্ষক গোলাম মোস্তফার মৃত্যুর পর ৩ যমজসহ ৫ সন্তানকে নিয়ে সংসারের ঘানি একাই টেনে চলেছেন আর্জিনা বেগম। সংসার জীবনে তারজন্য সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল শিক্ষক স্বামীর সন্তানদের শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। দরিদ্র সংসার থেকে সন্তানদের শিক্ষাব্যয় মেটানো ছিল কঠিন। স্বামীর এবং বাবার বাড়ির জমি বিক্রি করে তিনি সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগান দিয়েছেন। দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করে একদিকে সংসার চালিয়েছেন, অন্যদিকে মায়ের স্নেহ-মমতার পাশাপাশি বাবার অভাব পূরণেও ভূমিকা রেখেছেন।
আর্জিনা বেগম আরও বলেন, বাবার স্নেহ মমতা কিছুই পায়নি ওরা। তাদের প্রায় ৫ বিঘা জমি ছিল। নিজে কষ্ট করে জমি বিক্রি করে ওদের পড়ালেখা করিয়েছি। বাকি যা আছে তাও প্রয়োজনে বিক্রি করবেন, তবুও ওদের ডাক্তার বানাব।
গত শিক্ষাবর্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া মাফিউল হাসান বলেন, নিজে প্রথমবার চান্স পেলেও বাকি দুই ভাইয়ের ইচ্ছেপূরণ না হওয়ায় মনের মধ্যে কষ্ট থেকে যায়। এবার বাকিরা ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় নিজের মেডিকেল চান্স পাবার আন্দন পূর্ণতা পেল।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে চান্সপ্রাপ্ত সাফিউল বলেন, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে এক চিকিৎসকের কাছে যান তিনি। চিকিৎসকের কথা এবং আচরণে তার মনে হয় অসুস্থতা অর্ধেক কমে গেছে। একজন মানুষের কথা কিংবা ব্যবহার এত সহজে মানুষকে সুস্থ করে দিতে পারে। সেই ভাবনা থেকে সেদিনই বড় হয়ে চিকিৎসক হবার স্বপ্ন দেখেন সাফিউল।
অন্যদিকে, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়া রাফিউল ইসলাম বলেন, প্রথমবার আমাদের এক ভাই চান্স পেয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল আমাদের কষ্টের টাকা একটু হলেও কাজে লেগেছে। মা আর তিন ভাইয়ের যৌথস্বপ্ন পূরণে চেষ্টা করে গেছেন আবারও। এবার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন এই ৩ ভাই।
যমজ তিন সহোদর আরও বলেন, মা আমাদের বাবার অভাব বুঝতে দেননি। নিজে কষ্ট করেছেন, কিন্তু আমাদের কষ্ট করতে দেননি। অসুস্থ হয়ে বাবার মৃত্যু হয়েছে, এটা বোঝার পর থেকে আমাদের ডাক্তার হওয়ার সুপ্ত বাসনা ছিল। আমরা স্বপ্নপূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। অনেকেই আমাদের লেখাপড়ার জন্য সহযোগিতা করেছেন। প্রাথমিকভাবে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, আমরা আনন্দিত। তবে এই আনন্দ বাবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারলে আরো বেশি আনন্দ পেতাম। মেডিকেলে শিক্ষা জীবন শেষ করে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করতে চাই।
ধুনট সরকারি নইম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তফিজ উদ্দিন বলেন, মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে তিন সহোদর স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের এই খবর স্কুলের জন্য গৌরবের। আমরা তাদের সঙ্গে ছবি তুলেছি, মিষ্টিমুখ করেছি। প্রত্যাশা করছি, তারা সাফল্যের সঙ্গে মেডিকেল কলেজের শিক্ষা জীবন শেষ করবে।
শাহ সুলতান কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শহীদুল ইসলাম জানান, শুনেছি তিন জমজ ভাই এর মধ্যে গতবার একজন এবং দুজন মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। ওদের জন্য দোয়া থাকল।