মুন্সিগঞ্জ ও মাদারীপুরের স্পিডবোট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় ‘অবৈধভাবে’ স্পিডবোট চলাচল করে। ‘সিন্ডিকেট’ করে যাত্রীদের কাছ থেকে চড়া ভাড়া আদায় করা হয় এবং কম মূল্যে ঘাট ইজারাও নেন তাঁরা। অবশ্য এ কাজে তাঁদের সহায়তা করেন স্থানীয় প্রশাসন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারা। ঘাট থেকে আসা অর্থের একটি অংশ তাঁরা পান বলে অনিয়ম নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ঘাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য গত সোমবার স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যুর পর প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউন’ শেষে যাদের অনুমোদন থাকবে না, তাদের চলতে দেওয়া হবে না।
যাঁদের হাতে নিয়ন্ত্রণ
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামে যাতায়াতের বড় একটি নৌপথ শিমুলিয়া এবং বাংলাবাজার ও মাঝিরঘাট। এ রুটে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোটে যাত্রী পরিবহন করা হয়। সাধারণ সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ তিন ঘাট দিয়ে স্পিডবোটে চলাচল করে। কারণ, এ নৌযানে পদ্মা পার হতে সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। তিনটি ঘাটকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪৫০টি স্পিডবোট চলাচল করে। স্থানীয় প্রশাসন, স্পিডবোটের মালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটের স্পিডবোট নিয়ন্ত্রণ করেন মেদেনীমণ্ডল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন খান। তাঁর ছোট ভাই শাহ আলম খান এ ঘাটের ইজারাদার। আশরাফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবৈধ হলে সরকারি সংস্থা ঘাট ইজারা দেয় কী করে? কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইজারা নিয়েছি। তাই স্পিডবোট চলছে।’
মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটের স্পিডবোট চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার, যিনি পাঁচ্চর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও শিবচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। এ ঘাটের ইজারাদার ইয়াকুব ব্যাপারী, যিনি কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘নিয়ম মেনেই আমরা স্পিডবোটে যাত্রী পরিবহন করছি। স্পিডবোট চলাচলে স্থানীয় প্রশাসনই আমাদের সহযোগিতা ও অনুমতি দিয়ে থাকে।’
শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরঘাটের স্পিডবোট চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নেছার উদ্দিন মাতবর ও সাংগঠনিক সম্পাদক আলতাফ হোসেন খান। এ ঘাটের ইজারা পান আলতাফ হোসেন খানের ভাই মনির হোসেন খান। মুঠোফোনে আলতাফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইজারা বাবদ যাত্রীর কাছ থেকে ১০ টাকা করে নিই। আর স্পিডবোট বৈধ-অবৈধর বিষয়টি প্রশাসনই ভালো বলতে পারবে।’
কত টাকা ওঠে
একটি স্পিডবোটের একটি ট্রিপে ধারণক্ষমতাভেদে ২২ থেকে ৩২ জন যাত্রী নেওয়া হয়। একজন যাত্রীর কাছ থেকে ১৫০ টাকা করে নেওয়া হয়। দিনে এ রুট দিয়ে কত মানুষ যাতায়াত করে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায়নি। স্পিডবোটমালিক ও চালকেরা জানান, প্রতি টিকিটের বিপরীতে ঘাটভেদে ২৫ থেকে ৫০ টাকা কেটে রাখেন ইজারাদারের লোকজন। এ ছাড়া সিরিয়াল দিতেও প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। এ টাকার ভাগ চলে যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, যেখানে যাত্রীদের যেমন চড়া ভাড়া দিতে হচ্ছে, তেমনি পদে পদে দুর্ব্যবহারের শিকার হতে হয়।
যাত্রীদের অভিযোগ, স্পিডবোটে বেশি যাত্রী ওঠানোর জন্য এমন গাদাগাদি করে বসানো হয় যে কেউ ‘লাইফ জ্যাকেট’ পরে বসতে পারেন না। পরার জন্য সময়ও দেওয়া হয় না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলেই মৃত্যু বেড়ে যায়। জানা গেছে, করোনার আগে ভাড়া ছিল ১২০ টাকা। স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য যাত্রী কম নেওয়ার শর্তে ভাড়া ১৫০ টাকা করা হয়েছিল। এরপর স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, ভাড়া দিতে হচ্ছে বেশি। এ পথ দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী বরিশালের নেয়ামত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এত কম পথে ১৫০ টাকা ভাড়া, যা অত্যন্ত বেশি। যাত্রীর চাপ দেখলেই ভাড়া বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়। ঈদের সময় তা ৩০০ টাকা নেওয়া হয়। প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। বিআইডব্লিউটিএর একটি সূত্র জানায়, গত বছর শিমুলিয়া ঘাটের ইজারামূল্যও কমেছে। সিন্ডিকেট করে এ মূল্য কমানো হয়েছে। ঘাটের ইজারা থেকে সরকার পেয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, আগের বছর তা ছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা।
চুরি-ছিনতাইয়ে স্পিডবোট
যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজেও স্পিডবোট ব্যবহার করা হচ্ছে। স্পিডবোটের কোনো নিবন্ধন নম্বর থাকে না। ফলে অপরাধ করার পর অপরাধী ও মালিককে শনাক্ত করা যায় না। যেমন ২০১৯ সালে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের কার্তিকপুর বাজারে একদল দুর্বৃত্ত ডাকাতি করে। ডাকাত দল দুটি স্পিডবোটযোগে নদীপথে বাজারে আসে। জনতার তাড়া খেয়ে পালানোর সময় একটি স্পিডবোট বিকল হয় পড়লে সেটি জব্দ করা হয়। কিন্তু পুলিশ ওই স্পিডবোটের মালিককে শনাক্ত করতে পারেনি।
মা ইলিশ শিকারেও স্পিডবোট ব্যবহার করা হয়। গত দুই বছরে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের সময় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাতে ইলিশ ধরাকালে স্পিডবোটের সংঘর্ষে ১০ জন মারা যান। ওই সময় শরীয়তপুরে স্থানীয় প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগ অভিযান চালিয়ে ৫৮টি স্পিডবোট জব্দ করে। পরবর্তী সময়ে উপজেলা প্রশাসন নিলামে স্পিডবোটগুলো বিক্রি করে, যা যোগসাজশে মালিকেরাই কিনে নেন।
মাঝিরঘাটের স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি নেছার উদ্দিন মাদবর বলেন, ‘বোটমালিক ও চালকেরা গোপনে জেলেদের কাছে ভাড়া দেন। তাঁরা আমাদের কথাও শোনেন না।’ তিনি বলেন, ‘প্রশাসন জব্দ করলে আমরাই টাকা খরচ করে তা নিলামে ক্রয় করে ফিরিয়ে আনি।’ নৌ–নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি, শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরঘাট ও নড়িয়ার সুরেশ্বরে নৌ–পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। চরজানাজাত নৌ–পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীতে সব সময় টহল দেওয়ার মতো জনবল ও নৌযান আমাদের নেই।’