বাংলাদেশের এই গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণে বিশ্বের বাকি অংশ হয় নিরুৎসাহিত, আর না হয় হতাশ। কিন্তু এই বিষয়ে বৈশ্বিক অস্বীকৃতি তুলনামূলকভাবে মৃদু বা হালকা। বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় সামনে এনেছে আন্তর্জাতিক সাময়িকী ফরেন পলিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংসদে ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২২২টি আসন জিতেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটি ২৫৭টি আসন পেয়েছিল। অন্য অনেক দলের মতোই প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই নির্বাচন বর্জন করে এবং অনেক বিএনপি নেতা ও বিরোধী কর্মী নির্বাচনের সময় কারাগারে ছিলেন।
এছাড়া বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটের ব্যালটে তথাকথিত ডামি প্রার্থীও ছিল।
গাজা ও ইউক্রেনের যুদ্ধের দিকে সারাবিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় শেখ হাসিনা হয়তো জানতেন- বাংলাদেশের নির্বাচনে কেউ তেমন মনোযোগ দেবে না। ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানোসহ তারা হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক নেতারা রাষ্ট্রীয় ভাতাসহ নানা কল্যাণমূলক সুবিধার ওপর নির্ভরশীল লোকদের সতর্ক করে বলেছে, ভোট দিতে না গেলে তারা তাদের সুবিধা হারাবে।
২০১৮ সালে রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল এবং সেখানে বিশ্বাসযোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক নির্বাচনী জালিয়াতি কারণে — সেইসাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করতে আওয়ামী লীগের অস্বীকৃতির কারণে — বিরোধীরা এই বছরের ভোট বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
যদিও আওয়ামী লীগ শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪০ শতাংশ — যা ২০১৮ সালের ভোটার উপস্থিতির অর্ধেক এবং গত তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমনকি পর্যবেক্ষকরা এই ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির পরিসংখ্যান নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
প্রতিশোধের শিকার হতে পারেন এমন উদ্বেগের কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বলেন, গত ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ চলার সময় তিনি বেশ কয়েকটি বুথে গিয়েছিলেন এবং কিছু বুথে দুপুর ২ টা পর্যন্ত মাত্র কয়েকজন ভোটার ছিল। এবং কিছু জায়গায় ভোট পড়েছে ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। বিকাল ৩টায়, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন জানায়, ভোট পড়েছে ২৭ শতাংশ। আর এরপর বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়ার আগের ঘণ্টায় তা বেড়ে ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে বলে জানায় নির্বাচন কমিশন।
এছাড়া নির্বাচন উপলক্ষ্যে ৭ জানুয়ারি ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে শেখ হাসিনার সরকার বিরোধীদের ওপর দমনপীড়নও অব্যাহত রেখেছিল। নির্বাচনের ঠিক আগে স্থানীয় একটি আদালত বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ও ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তক মোহাম্মদ ইউনূসকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ডের সাজা দেয়।
ড. ইউনূস একসময় রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দল গঠনের ভাবনা সামনে এনেছিলেন; শেখ হাসিনা তাকে ‘গরিবের রক্তচোষা’ বলেছেন। মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সেক্রেটারি-জেনারেল আইরিন খান বলেছেন, এই রায় ‘বিচারিক প্রতারণা’।
নির্বাচনের কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র অজ্ঞাতনামা বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। দেশটি তখন বলেছিল, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলসহ গণতন্ত্রকে দুর্বল করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ওই ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এই ভোটের পরে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়, নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এখন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দ্বিধার সম্মুখীন হয়েছে। এটাকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে যে, মার্কিন কূটনীতিকরাই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত বাংলাদেশের সরকারের নেতার সমালোচনা করেছেন — যদিও ওয়াশিংটন ইসলামি জঙ্গিবাদ দমনে ঢাকার সমর্থনের প্রশংসা করে থাকে।
এদিকে, ভারতের মোদি সম্ভবত বাংলাদেশের এই নির্বাচনের ফলাফলে খুশি। তার আঞ্চলিক অংশীদারদের প্রয়োজন, বিশেষ করে তিনি যখন চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েছেন। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জনেরও বেশি ভারতীয় সৈন্য নিহত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক ঠিক ততটাই খারাপ হয়েছে, যতটা খারাপ কেবল যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতের কারণে হতে পারে।
এছাড়া চলতি বছরের শুরুতে ভারতীয় একটি দ্বীপপুঞ্জে মোদির অবকাশ যাপনকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের সাথে ভারতের কূটনৈতিক বিবাদ দেখা দিয়েছে। এর জেরে মোদির সমর্থকরা মালদ্বীপের চেয়ে ভারতের সমুদ্র সৈকতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও এই ঘটনায় মালদ্বীপ আরও দৃঢ়ভাবে চীনের শিবিরে চলে গেছে।
আর সর্বশেষ শ্রীলঙ্কায় একটি ভারতীয় কোম্পানির গ্রিন এনার্জি প্রকল্পের সম্ভাব্য বিপর্যয় কলম্বোর সাথেও ভারতের সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলেছে।