গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ইতোমধ্যে সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। যাত্রা শুরু করেছে নতুন সরকারও। আগামী ৩০ জানুয়ারি প্রথম সংসদ অধিবেশনের তারিখও ধার্য হয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি বিরোধী দল কারা হবে। জাতীয় পার্টি নাকি স্বতন্ত্র এমপিদের মোর্চা- এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে কিছু না বলায় কাটছে না ধোঁয়াশা। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এটা নির্ভর করছে সংসদ নেতা ও স্পিকারের ওপর। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন কে বসবে বিরোধী দলের চেয়ারে।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বাইরে এককভাবে অর্থাৎ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ৬২ জন, যাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ায়ামী লীগের। এই নির্বাচনে এককভাবে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২৩টি এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দল হিসেবে জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন।
সংবিধান বা সংসদ পরিচালিত হয় যে কার্যপ্রণালি বিধির দ্বারা, তার কোথাও বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে, সংসদের বিরোধী দল হওয়ার জন্য ন্যূনতম কতগুলো আসন পেতে হবে। তবে এরকম একটি রেওয়াজ আছে যে, মোট আসনের অন্তত এক দশমাংশ না পেলে সেই দলকে বিরোধী দল বলা যায় না। তার মানে ৩০০ আসনের সংসদে অন্তত ৩০টি আসন থাকতে হবে। প্রতিবেশী ভারতে এই চর্চা রয়েছে। যেমন: এই মুহূর্তে ভারতের লোকসভায় কোনো বিরোধী দলীয় নেতা নেই। ৫৪৫ জনের ভারতের লোকসভায় কমপক্ষে এক–দশমাংশ আসন না পেলে সেই দলকে বিরোধী দল হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশের সংবিধান বা কার্যপ্রণালিবিধিতে বিরোধী দলের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। বরং স্পিকার চাইলে তার বিবেচনামতে সংসদে বিরোধিতাকারী দল বা সংঘের নেতাকে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন। এখানে তার একক ক্ষমতা রয়েছে। অবশ্য স্পিকার সাধারণত সংসদ নেতার সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অতএব জাতীয় পার্টিকেই বিরোধী দল এবং সেই দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকেই বিরোধী দলীয় নেতা ঘোষণা করতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
এদিকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের মোর্চা বিরোধী দলে বসতে পারে এমন একটা গুঞ্জন জোরেশোরে প্রচারিত হচ্ছে। তবে দুই-একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বিচ্ছিন্নভাবে এই বিষয়ে কথা বললেও এটা নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বা বৈঠক হয়নি৷ সরকারের সঙ্গেও তারা এ নিয়ে কোনো যোগাযোগ করেননি বলে জানা গেছে৷
নিজেদের বিরোধী দল বলে দাবি করে জাতীয় পার্টি বলছে, বিরোধী দলের বিষয়টি মীমাংসিত। এটা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলার কিছু নেই। যদিও জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের এই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন, যদি আওয়ামী লীগ না চায় তাহলে ভিন্নকথা। আর মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, আমরাই বিরোধী দল৷ বাকিটা এখন স্পিকারের এখতিয়ার৷
বিরোধী দলের আসনে বসার ব্যাপারে স্বতন্ত্রদের মধ্যে প্রকাশ্যে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন ফরিদপুর-৩ আসন থেকে বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একে আজাদ। তিনি বলেন, যেহেতু জাতীয় পার্টি মাত্র ১১টি সিট পেয়েছে আর স্বতন্ত্র পেয়েছে ৬২টি, যদি নেত্রী (শেখ হাসিনা) মনে করেন, আমাদের বিরোধী দল গঠন করা উচিত৷
ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরীও (নিক্সন চৌধুরী) এই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এখনো বিরোধী দল গঠন হয়নি৷ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব৷ আমরা অবশ্যই জোট গঠন করব৷
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের মধ্যে তিনজন সদস্য ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী লীগের৷ আর আওয়ামী লীগের যারা তাদের মধ্যে দুইজন বাদে সবারই দলীয় পদ আছে। সুতরাং তারা কীভাবে বিরোধী দল হবে, এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।
এছাড়া স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ী বেশির ভাগ সংসদ সদস্যই বিরোধী দলে বসার ব্যাপারে আগ্রহী নয় বলে জানা গেছে। নওগাঁ-৬ থেকে বিজয়ী স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে জয়ী অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক৷ তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমাকে নেত্রী নৌকা প্রতীক দিতে পারেননি৷ কিন্তু তিনি তো আমাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন৷ আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক৷ শেখ হাসিনা আমার নেতা৷ তাকে সহযোগিতা করাই আমার কাজ৷ সরকারি দল বা বিরোধী দল ওসব কিছু না৷ নেত্রী যা বলবেন আমি তাই করব৷ আর এর পরেরবার আমি তো নৌকা প্রতীক পাবো নিশ্চিত৷
পিরোজপুর-৩ আসনের শামীম শাহনেওয়াজ বলেন, আমরা ৬২ জন প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের৷ তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেন ওটার দিকে আমরা তাকিয়ে আছি৷ দেখা যাক৷ আমরা আবার নিজেদের মতোও থাকতে পারি৷ প্রধানমন্ত্রী কী সিদ্ধান্ত দেন দেখি৷
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বিরোধী দলে বসতে আইনগত কোনো বাধা নেই জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, স্বতন্ত্রদের বিরোধী দল হতে সংবিধান বা আইনে কোনো বাধা নেই৷ তাদের দেখাতে হবে তাদের যে দল বা অধিসঙ্গ তা এখন যে বিরোধী দল আছে (জাতীয় পার্টি) তাদের ১১ জনের চেয়ে স্বতন্ত্রদের সংখ্যা বেশি৷ তবে কার্যপ্রণালী বিধিতে শর্ত আছে৷ বিরোধী দলীয় নেতাকে তার দল নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করতে হবে৷ এখন কেউ যদি বলে সে সরকারি দলের কমিটিতে থেকে সরকারি দলের বিরোধিতা করবে এটা তো কন্ট্রাডিকটরি হয়৷ তারা দলীয় পদ বহাল রেখে সম্ভবত বিরোধী দল হতে পারবে না।
তবে তিনি তিনি মনে করেন, যদি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা দলীয় পদ স্থগিত করে বিরোধী দল হন তাহলে হয়তো হতে পারে৷ তবে আমার মনে হয় প্রাকটিক্যালি এটা হওয়ার সম্ভাবনা কম৷