চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমবে এবং মূল্যস্ফীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গেল মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) রাতে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ শীর্ষক ষাণ্মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে আনুমানিক ৬ শতাংশ। যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। পূর্ববর্তী ২০২২-২৩ অর্থবছরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একই থাকলেও সাময়িক হিসাবে তা হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। তবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়বে এবং তা ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এছাড়াও চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এতে বলা হয়, মূলত ব্যক্তিমানুষের ভোগব্যয়ের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তি থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নমুখী থাকায় আমদানি নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে এবং সে কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের রফতানি নিয়ে বিশ্বব্যাংক বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না এবং বিষয়টি প্রবৃদ্ধির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতিটাকে কমানো, ডলারের যোগান বাড়ানো, আর্থিক খাতের যে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলোকে সবল করা। সেগুলোকে একটা রেজুলেশনের পথে নিয়ে যাওয়া। একদিকে দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ আছে, আরেক দিকে তাদের মূলধন ঘাটতিও বিরাট। লাইফ সাপোর্ট ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানগুলো সচল থাকতে পারে না। এটাকে এক কথায় বলতে গেলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার যে ফাটলগুলো আছে ক্র্যাক, ইউকনেসেস, এগুলোকে এডজাস্ট করতে না পারলে অন্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে যায়। স্টাবিলিটিটা অক্সিজেনের মতো। এটা যদি না থাকে তাহলে যেমন শ্বাস নিতে কষ্ট হবে। আর শ্বাস নিতে যদি না পারে তবে রোগীর গায়ে ফোঁড়া থাকল না হাড়ে ব্যথা থাকল ওগুলার চিকিৎসার তো আর গুরুত্ব থাকল না। প্রায়োরিটিটা দিতে হবে আগে শ্বাস নেওয়া। একইভাবে আমার যদি ডলার না থাকে, মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে, দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে, আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি দুর্বল হতেই থাকে, তাহলে অন্য ক্ষেত্রে কাজ করবেন কীভাবে? সারাক্ষণ একটা ফায়ার সাইডিং মোডে থাকতে হবে। এখন সরকারকে টপ প্রায়োরিটি দিয়ে কাজ করতে হবে তিন বিষয়ে। মূল্যস্ফীতি কমানো, ডলারের যোগান বাড়ানো, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাগুলোকে নিষ্পত্তির জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন মুদ্রানীতি চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য টাকার সরবরাহ কমানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। আর টাকার যোগান কমাতে ঋণের সুদের হার বাড়ানো হবে। এজন্য ট্রেজারি বন্ড বিলের সুদ হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সুদের হার বাড়লে ঋণ কমবে। এতে বিনিয়োগে টান পড়বে। অপরদিকে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি, সিএমএসএমই ও অর্থায়ন স্কিমের সুদের হার বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা থাকছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেপথ্য ডলার সংকট গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করেন ডলারের রেট বাজারভিত্তিক করতে ক্রলিং পেগ (নিয়ন্ত্রিত হলে পরিবর্তনশীল) নতুন পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। রেমিট্যান্স বাড়াতে উদ্যোগ থাকছে। পাশাপাশি পণ্যের মূল্য কমাতে মনিটরিং সেল গঠনের প্রস্তাব করান হয়েছে। যা আগামী ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে অনুমোদন হতে যাচ্ছে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আগামী ১৫ জানুয়ারি মনিটরি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস) ঘোষণা করতে পারেন। দেশের আর্থিক খাতের প্রধান সমস্যাই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ও স্থানীয় মুদ্রার সংকট, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা। এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে সরকার ঘোষিত জিডিপি এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় ষাণ্মাসিকের (জানুয়ারি-জুন) জন্য একই থাকছে। নানা কারণে পুরোপুরি তদারকিতেও চাপে পড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন বছরের প্রথম ছয় মাসের মুদ্রানীতিতেও নীতি সুদের হার আরও বাড়িয়ে টাকার অবমূল্যায়ন কমানো হবে। এতে সুদহার বেড়ে মূল্যস্ফীতি কমে আসে। আর বাকি নীতি চলবে আগের মতোই।