সম্প্রতি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পেয়েছে ২৩ হাজার ১৮৪ জন কারাবন্দি। তাদের মধ্যে রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার রোহিঙ্গারাও রয়েছে, যাদের বেশির ভাগই সহিংসতাসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসমূলক অপরাধে আটক হয়েছিল। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের অনেকে বাংলাদেশে ঢুকতে তৎপর। এসব দাগি আসামি ও সন্ত্রাসীর অনুপ্রবেশ নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। গত এপ্রিলে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে ৪৮ জন রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত পাঠিয়েছে বলে জানা যায়। এর পরও মিয়ানমারের বিভিন্ন জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত রোহিঙ্গারা নানা কৌশলে বাংলাদেশে ঢুকছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য মতে, গত ২৯ এপ্রিল টেকনাফের শালবাগান ও উনছিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছয়জন রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ করে। এর আগে আরো চারজন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসে। তারা উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে এ দেশে ঢুকেছে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যেকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তিপ্রাপ্ত এবং ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন সহিংসতার সময় বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের দায়ে মিয়ানমার বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিল।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক (এসপি) মো. তারিকুল ইসলাম গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে সম্প্রতি মিয়ানমার জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ১৫ জন রোহিঙ্গা টেকনাফের ক্যাম্পে তাদের আত্মীয়দের কাছে এসেছে। আমরা তথ্য পাওয়ার পর বিষয়টি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারকে (আরআরআরসি) জানিয়েছি। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের অনেককে উখিয়ায় ট্রানজিট ঘাটে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি জানান, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্য মতে, মিয়ানমারে সাধারণ ক্ষমায় যেসব রোহিঙ্গা মুক্তি পেয়েছে তাদের প্রত্যেকে বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। সে অনুযায়ী প্রায় ৬০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
সরেজমিন টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে জানা যায়, মংডু বুথিডং জেল থেকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় প্রায় ৬২২ জন রোহিঙ্গা মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে বড় গজবিল নামক এক এলাকার ৬৫ জন রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের মধ্যে ২৫ জন মুক্তিপ্রাপ্ত রোহিঙ্গা বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে এরই মধ্যে শালবাগান ক্যাম্পে তাদের বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে রয়েছে।
শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যুবক মোহাম্মদ হানিফ জানান, তাঁর বাড়ি মংডুর বড় গজবিল এলাকায়। এ এলাকার যেসব রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের আগস্টে সহিংসতার সময় আটক হয়েছিল, তাদের মধ্যে মুক্তি পেয়ে ২৫ জন রোহিঙ্গা এই ক্যাম্পে এসেছে। সব মিলিয়ে নানা এলাকা থেকে এরই মধ্যে শতাধিক রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে ঢুকেছে বলে তাঁরা রোহিঙ্গা কমিউনিটির মাধ্যমে জেনেছেন। অন্যরাও আসার জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজছে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সবাই আসতে পারে বলে হানিফ জানান।
শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসা বড় গজবিল এলাকার রোহিঙ্গা রাহমাত উল্লাহ বলেন, ‘২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তখন আমার স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আমি মুক্তি পেয়ে এখন বাংলাদেশে আশ্রিত আমার স্বজনদের কাছে চলে আসছি। আমরা আটজন একসঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ি।’
এদিকে নতুন করে এসব রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠায় উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ। তারা বলছে, রাখাইনের সহিংসতার সময় মিয়ানমার বাহিনীর হাতে যেসব রোহিঙ্গা আটক হয়েছিল তাদের অনেকেই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী এবং দাগি অপরাধী। তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা উগ্রপন্থী ও সশস্ত্র। এখন তারা যদি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে তাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ পুরো কক্সবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাস্টার জাহেদ হোসেন বলেন, ‘সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পাওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকানো দরকার। তারা আসলে বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র গ্রুপ তৈরিসহ রোহিঙ্গা যুবকদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে পারে।’ যারা বিভিন্ন উপায়ে ঢুকে পড়েছে, তাদের বিশেষ নজরদারিতে রাখা জরুরি বলে মত দেন তিনি। জনাতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, তাঁরা এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে।